শেরপুরের নালিতাবাড়ি উপজেলার পোড়াগাঁও ইউনিয়নের অবহেলিত গ্রাম খলচান্দা কোচ পাড়া। এখানে বাস করেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোচ সম্প্রদায়ের ৫৫টি পরিবারের প্রায় ৫ শতাধিক মানুষ। তারা বাংলাদেশ জন্ম হওয়ার আগে থেকে ওই গ্রামে বসবাস করেন। এরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোচ সম্প্রদায়ের মানুষ হওয়ায় এদের পোষাকে রয়েছে ভিন্নতা। ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানে এ সম্প্রদায়ের পুরুষরা পড়েন ধুতি। আর নারীরা পড়েন রাঙ্গা লেফেন। নারীরা এই রাঙ্গা লেফেন নিজেদের হস্তশিল্পের তাঁত বা যন্ত্র দিয়ে নিজ হাতেই তৈরি করে থাকেন।
খলচান্দা গ্রামের কোচরা জানান, রাঙ্গা লেফেন বানাতে যে সুতার প্রয়োজন হয় তার দাম অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে এখন খুব বেশি রাঙ্গা লেফেন বানান না। আগে প্রায় প্রতি ঘরের নারীরা তাদের তৈরি রাঙ্গা লেফেন পড়তেন। দীর্ঘ বছর ধরে রাঙ্গা লেফেন না বানানোয় অনেকেই এটি বানানো ভুলে গেছেন। তাই হারিয়ে যেতে বসেছে কোচদের ঐতিহ্যের পোষাক রাঙ্গা লেফেন। হঠাৎ দুই একটি পরিবারের নারীরা অনেকটা শখের বসে মাঝে মধ্যে নিজেদের যন্ত্র দিয়ে রাঙ্গা লেফেন বানিয়ে থাকেন। বিশেষ করে তাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে কিংবা নিজস্ব সাষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিধান করার জন্য।
খলচান্দা গ্রামের রমেশ কোচের বাড়িতে গিয়ে দেখা মেলে রাঙ্গা লেফেন তৈরির তাঁত। তার স্ত্রী সীতা রাণী কোচ নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় বসে রাঙ্গা লেফেন তৈরি করছেন। তিনি জানান, রাঙ্গা লেফেন তৈরির নিজস্ব তাঁত বা যন্ত্র থাকলেও সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে লেফেন তৈরি করেন না। ৫ হাত লম্বা একটি রাঙ্গা লেফেন বানাতে প্রায় ৭৫০ গ্রাম সুতার প্রয়োজন হয়। প্রতি কেজি সুতার দাম এখন ৬শ টাকা। প্রতিটি লেফেন বানাতে সুতা বাবদ খরচ হয় ৪শ ৫০ টাকা। তৈরি করতে সময় লাগে ৫/৬ দিন। বর্তমান এর বাজার দাম রয়েছে ৮শ থেকে ১ হাজার টাকা। শ্রমের মজুরীতে না পুষালেও নিজের নাতনীর সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিধানের জন্য নিজ হাতেই তিনি তৈরি করছেন রাঙ্গা লেফেন।
সীতা রাণী জানান, রাঙ্গা লেফেনের তাঁত যনেত্র জন্য প্রয়োজন হয় কাঁঠ বা বাঁশের তৈরি কয়েকটি যন্ত্রাংশ। ক্ষুদ্র এ যন্ত্রাংশগুলোর নাম হলো- গাড়ী, রাজ, দোহী, মাখু, বড়াই, ঠোঙ্গা, কন্ঠাছান্দা, থেরথেবা, নাটাই, খুঁটি ও চরকী। এর প্রধান কাঁচামাল হলো সুতা। সব মিলিয়ে কোচদের নিজস্ব তাঁতযন্ত্র বানাতে খরচ পড়ে ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। তিনি আরো জানান, তার পুর্ব পুরুষদের কাছ থেকে এই নিখুঁত ও সুন্দর রাঙ্গা লেফেন বানানো শিখেছেন। বর্তমান যুগের নারীর অনেকেই রাঙ্গা লেফেন বানাতে পারেন না। আবার অনেকেই ভুলে যাচ্ছেন। সুতার পর্যাপ্ত সরবরাহ ও দাম থাকলে অনেক পরিবারই নিজেরাই এই ঐতিহ্যের পোষাক তৈরি করতেন। কোচরা নানা প্রতিকূলতায় তাদের এই শত শত বছর ধরে সনাতনী বিলুপ্তপ্রায় তাঁতশিল্প নিয়ে কারও কাছেই কোনো অভিযোগ-অনুযোগ নেই। সরকারের কাছেও তারা কখনও সাহায্য-সহযোগিতার কথা জানায়নি। বলতে গেলে সে রাস্তাটি তাদের জানা নেই। তাই নীরবে-নিভৃতে গারো পাহাড়ের সবুজেঘেরা উঁচু-নিচু টিলার ভাঁজে ভাঁজে তাদের সে স্বপ্নগুলো সাদা-কালোই রয়ে গেছে।
খলচান্দা গ্রামের বাসিন্দা মায়াদেবী কোচ বলেন, আমাদের পোষাকের ঐতিহ্য রক্ষায় তাঁত শিল্পে স্থানীয় একটি বেসরকারী সংস্থা প্রশিক্ষণ দিলেও এখন আর খবর নেয় না। তিনি কোচদের এই ঐতিহ্যের পোষাক রক্ষার দাবী জানান।
স্থানীয় কোচ নেতা ও অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক পরিমল কোচ বলেন, আমাদের এ গ্রামের কোচরা রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, শিক্ষা-স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে সব বিষয়েই পিছিয়ে আছে এবং অবহেলিত। ফলে দিন দিন আমাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। জীবনের তাগিতে অন্যত্র পাড়ি জমাচ্ছে। ফলে হারিয়েও যাচ্ছে আমাদের অস্তিত্ব, ঐতিহ্য ও শিল্প। এ বিষয়ে সরকারেরই এগিয়ে এসে আদিবাসী কোচদের বিলুপ্ত প্রায় তাঁত শিল্পটা বাঁচাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার।
এ বিষয়ে নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা খৃষ্টফার হিমেল রিছিল বলেন, সীতা রাণীর তাঁত শিল্প পরিদর্শন করা হয়েছে। কোচ সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংষ্কৃতি রক্ষায় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।