পার্বত্য চট্টগ্রামে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠিদের মধ্যে মারমাদের প্রধান সামাজিক উৎসব সাংগ্রাই বা জল উৎসব। পুরাতন বছরকে বিদায় নতুন বর্ষ বরনের এই উৎসবকে কেন্দ্র করে মারমা পাড়াতে বইছে জল উৎসবের জোয়ার। করোনার কারণে গত দুই বছর জলোৎসব না হওয়ায় এবছর যেন উৎসবে মাতোয়ারা হয় উঠেছে পাহাড়ের মানুষ। আর মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী সাংগ্রাই জল উৎসবের আয়োজনের মধ্যদিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাই, বৈসুক, বিষু, বিহু শেষ হচ্ছে। তবে মারমাদের পানি খেলা মধ্যদিয়ে বৈসাবী উৎসব শেষ হয়ে গেলেও এর রেশ থেকে যায় প্রায় পুরো এপ্রিল মাস জুড়ে।
পার্বত্য অঞ্চলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সাংস্কৃতি বিকাশে এগিয়ে আসুন এই শ্লোগানে রোববার (১৬ এপ্রিল) দুপুরে রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়াতে অনুষ্ঠিত হলো দিনব্যাপী মারমা সাংস্কৃতিক সংস্থা (মাসস) এর আয়োজনে সাংগ্রাই উৎসব। মারমাদের ঐতিহ্যবাহী পিতলের মং ঘণ্টা বাজিয়ে সাংগ্রাই উৎসব উদ্বোধন করেন, রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি।
রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও মাসস এর সভাপতি অংসুইপ্রু চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সময় গেষ্ট অব অনার হিসাবে উপস্থিত ছিলেন, জ¦ালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সংরক্ষিত মহিলা সংসদ সদস্য বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান।
এসময় রাঙ্গামাটি সংসদ সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি দীপংকর তালুকদার এমপি বলেন, সাংগ্রাই উৎসব শুধু মারমা সম্প্রদায়ের নয়- এ উৎসবকে এই এলাকায় বসবাসরত সব সম্প্রদায়ের উৎসবে পরিণত করতে হবে। এ ধরনের অনুষ্ঠান এ এলাকায় বসবাসরত সব সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে আরো সুদৃঢ় করে তুলবে। তিনি বলেন, এখন সময় এসেছে তা সবার মাঝে পৌঁছে দেয়ার। এখানে বসবাসরত হিন্দু, মুসলমান, চাকমা, মারমাসহ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যেসব জাতিসত্তা রয়েছে তারা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। এক কথায়, আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমাদের মাঝে কোনো ভেদাভেদ নাই। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব ভাষাভাষী সম্প্রদায়ের বিশ্বাসকে সরকার অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাই এ অঞ্চলের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নে যা যা করা প্রয়োজন তা করতে বর্তমান সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। যার যার যে ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে আমাদের সেগুলোকে গুরুত্ব দিতে হবে। পুরনো বছরের সব গ্লানি মুছে ফেলে নতুন বছরের শুভ কামনার জন্য বৃহত্তম এ আয়োজন করা হয়।
তিনি আরো বলেন, অসাম্প্রদায়িক চেতনার দেশ বাংলাদেশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আছে বলেই সারাদেশে ন্যায় পার্বত্য চট্টগ্রাম বসবাসরত সকল সম্প্রদায়ের মানুষ উৎসব মুখর পরিবেশে নিজ নিজ ধর্মীয় অনুষ্ঠান উদযাপন করতে পারছেন।
এসময় বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, রাঙ্গামাটি প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, কাপ্তাই জোনের জোন কমান্ডার লেঃ কর্নেল মোঃ নুর উল্লাহ জুয়েল, পিএসসি, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ সদস্য অংসুইচাইন চৌধুরী, রাজস্থলী উপজেলা চেয়ারম্যান উবাচ মারমা, রাজস্থলী নির্বাহী অফিসার শান্তনু কুমার দাশ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন, সাংগ্রাই জল উৎসব উদযাপন পরিষদের আহ্বায়ক ও রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের সদস্য নিউচিং মারমা ও মাসস এর সাধারণ সম্পাদক মংউচিং মারমা।
আলোচনা সভা শেষে মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী পিতলের মং ঘণ্টা বাজিয়ে সাংগ্রাই উৎসব উদ্বোধন করেন অতিথিরা। এরপর প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথিরা ফিতা কেটে সাংগ্রাঁই জল উৎসব উদ্বোধনের পর অতিথিরা মারমা যুবক যুবতিদের গায়ে পানি ছিটিয়ে জলকেলির শুভ সুচনা করেন। সাংগ্রাঁই জল উৎসব পর বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মারমা শিল্পিদের পরিবেশনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।
এসময় যুবক যুবতীরা একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে পুরনো বছরের সব দুঃখ, কষ্ট, গ্লানি ধুয়ে-মুছে দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে সাংগ্রাই জল উৎসবে মেতে ওঠেন। মারমা বিশ্বাস মতে, পবিত্র এ জল বর্ষণের মধ্যে দিয়ে পুরনো বছরের দুঃখ-কষ্ট, গ্লানী মুছে গিয়ে নতুন বছর সুখ বয়ে আনে। এছাড়া, প্রতি বছর সাংগ্রাই উপলক্ষে মারমা পল্লীতে বসে উৎসবের আসর। ঐতিহ্যবাহী এ জলকেলি বা পানি বর্ষণের মধ্যদিয়ে শেষ হবে পাহাড়ের বৈসাবি উৎসব।
উৎসবে হাজার হাজার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নর-নারী ছাড়াও কয়েক হাজার বাঙালি নর-নারী উপস্থিত থেকে এই উৎসবে অংশগ্রহণ করে নেচে গেয়ে আনন্দ উল্লাস করে নতুন বছরকে বছর করে নেয়। পাহাড়ি-বাঙালির পদধূলিতে এক মহামিলন মেলায় পরিণত হয় মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসব।