সারা দেশে ভয়ংকর অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। ইদানীং পত্রপত্রিকায় ‘কিশোর গ্যাং’-এর অপরাধ বিষয়ে প্রায়ই খবর বেরোচ্ছে। আমরা জানি আজকের শিশুরা আগামী দিনের উন্নত ও সমৃদ্ধশালী জাতির কর্ণধার। আর শিশু-কিশোররা যদি বিপথগামী হয় তাহলে জাতির ভবিষ্যৎ অন্ধকার। তবে আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাবগুলোর মধ্যে পারিবারিক ভাঙন, বিবাহবিচ্ছেদ, দাম্পত্য কলহ, পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অসামঞ্জস্যতা অন্যতম, যার ভুক্তভোগী বেশির ভাগ শিশু-কিশোররা। কিশোর অপরাধের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মা-বাবার সঠিক নজর দারির অভাবে এবং তাদের নিয়ন্ত্রণহীন জীবনযাপনের ফলে ছেলে মেয়েরা বখে যাচ্ছে। ফলে ছোট ছোট ভুলভ্রান্তি এবং অপরাধ করতে করতে পরবর্তীতে তারা বড় অপরাধ করে বসছে। আবার বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে চলতে চলতে মজার ছলে কিছু একটা করে বসে যা পরবর্তীতে বিরাট আকার ধারণ করে। এই সমস্ত ছোট ছোট অপরাধ যদি শুরুতে সাবধান করা যেত তাহলে অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসত। গ্রাম অপেক্ষা শহরে কিশোর অপরাধের ব্যাপকতা ও গভীরতা বেশি। বর্তমান সময়ে শিক্ষা হার ও মান বেড়েছে, অধিকাংশ পরিবারে বাবা-মা উভয়েই উচ্চশিক্ষিত; তারপরও শিশু-কিশোরদের আচরণে এত অধঃপতন। কিশোর অপরাধ সৃষ্টিতে শুধু কিশোররাই দায়ী নয়, এজন্য দায়ী আমাদের পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থাও। শহরগুলোতে আর্থসামাজিক বাস্তবতায় বাবা-মা উভয়েই বাসার বাইরে চাকরি, ব্যবসা তথা অর্থ উপার্জনে ব্যস্ত থাকেন। ফলে, সন্তান-সন্ততি উপযুক্ত স্নেহ-শাসন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তারা আচরণে বিদ্রোহী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও সংসারে অশান্তি, অভাব, বাব-মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ বা পৃথক থাকাও সন্তানদের নেতিবাচক মানসিকতায় প্রভাব ফেলে এবং সমাজবিরোধী কাজকর্মে লিপ্ত হয়। আধুনিকায়ন ও বিশ্বায়নের প্রভাবে সমাজে বসবাসরত কিশোরদের মধ্যে সামাজিক রীতি-নীতির অনুসরণের বাধ্যবাধকতাকে নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থতাস্বরূপ কিশোররা অপরাধে জড়িয়ে যাচ্ছে এবং একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিশোররা নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পরিবার ও সমাজের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় যদি সুষ্ঠুভাবে কিশোরের ব্যক্তিত্বের বিকাশ না ঘটে তাহলে ছেলেমেয়েরা কিশোর অপরাধী হয়ে উঠতে পারে। এজন্য একজন শিক্ষার্থী কার সঙ্গে মেলামেশা করছে এ বিষয়ে পরিবারের খোঁজ খবর রাখতে হবে। এখন পরিবারের অভিভাবকরা অনেকাংশ ব্যাপারে উদাসীন। যার কারণে স্কুল-কলেজগামী শিক্ষার্থীরা নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে অপকর্মে জড়িয়ে পড়ে। তাই পরিবার, সমাজের মুরব্বি, শিক্ষক-শিক্ষিকা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, মিডিয়াসহ প্রত্যেকের সচেতনতা খুবই প্রয়োজন, সাথে আমাদের সমাজব্যবস্থায় বিভিন্ন সৃজনশীল ও সাংস্কৃতিক আয়োজন বাড়াতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রকে শিশু বান্ধব নীতি তৈরি করতে হবে বা সরকার ও রাষ্ট্র যদি শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোর উন্নয়ন সাধন ও সেখানে শিশু চারিত্রিক উন্নয়নমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা এবং শিশুর জন্য উপযোগী বিনোদনমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। অন্যদিকে কিশোর অপরাধীসহ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য খেলাধুলার পাশাপাশি বিভিন্ন সাইকোলজিক্যাল সেমিনার ও ওয়ার্কশপের আয়োজন করতে হবে এবং কিশোর শিক্ষার্থীদের বয়স, সামর্থ্য ও অভিরুচির প্রতি লক্ষ্য রেখে পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করা। সন্তানের অবসর সময় কিভাবে কাটছে তা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। তবেই কিশোর অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে যাবে।