আগামী ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ক্ষতমাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো বৃহস্পতিবার (২০ এপ্রিল) বরিশালে আসছেন নৌকার প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত। তার আগমনকে ঘিরে নতুন সাজে সাজানো হয়েছে পুরো নগরীকে। পাশাপাশি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে খোকন সেরনিয়াবাতকে বরণ করে নেওয়ার জন্য জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কমপক্ষে দশ হাজার নেতাকর্মী প্রস্তুত রয়েছেন।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাওয়া আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত এখনো বরিশালে ফেরেননি। বৃহস্পতিবার সকালে সড়কপথে ঢাকা থেকে রওয়ানা করবে খোকন সেরনিয়াবাতকে বহনকারী গাড়িবহর। বেলা ১১ টায় গাড়িবহর নগরীর গড়িয়ারপাড় এলাকায় পৌঁছবে। সেখানে বরিশালের নেতাকর্মী ও সর্বস্তরের জনতা নতুন মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতকে স্বাগত জানাবেন। পরে সুসজ্জিত গাড়িবহর নিয়ে মিছিল সহকারে কয়েক হাজার মোটরসাইকেল, সহ¯্রাধীক প্রাইভেটকারসহ অন্যান্য যানবাহনে হাজার হাজার নেতাকর্মীরা নৌকার কা-ারী খোকন সেরনিয়াবাতে নিয়ে দলীয় কার্যালয় চত্বরে আসবেন।
সূত্রে আরও জানা গেছে, মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতের সাথে ঢাকা থেকে একসাথে বরিশালে আসবেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল সদর আসনের সংসদ সদস্য কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামীম সহ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন তার বিপক্ষে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। নৌকা প্রতীকের বিজয় নিশ্চিত করতে আমদের দলীয় প্রার্থীর পক্ষেই কাজ করতে হবে। এজন্য আসন্ন ঈদ-উল ফিতরের পর জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের যৌথ বর্ধিত সভা করা হবে। সেখানে আলাপ-আলোচনা করে প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করতে নির্বাচনী প্রচারে নামার বিষয়ে চূড়ান্ত করা হবে।
এর আগে গত রোববার টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আবার ঢাকায় ফিরে যান মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। এরপর প্রধানমন্ত্রী সহ দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করে নির্বাচনের যাবতীয় নির্দেশনা নিয়ে তিনি (খোকন) আজ বরিশালে ফিরছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন আমেনা বেগমের কনিষ্ঠ ছেলে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাত বর্ষীয়ান নেতা ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর ছোট ভাই এবং বর্তমান সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর একমাত্র চাচা।
নৌকার বিজয়ে একাট্টা আওয়ামী লীগ ॥ বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনকে ঘিরে বরিশালে আওয়ামী লীগের স্থানীয় রাজনীতির নতুন মেরুকরণ চলছে। চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ ওরফে খোকন সেরনিয়াবাতের সাথে মনোনয়ন লড়াইয়ে ভাতিজা বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ছিটকে পরলেও ভোটের মাঠে কোনো বিভেদ নেই। বরং দলীয় সিদ্ধান্তকে সফল করতে একাট্টা হয়েই তারা মাঠে থাকবেন বলে জানিয়েছে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ।
অপরদিকে আওয়ামী লীগের নতুন প্রার্থীকে নিয়ে সরব হয়েছে দলের কোণঠাসা নেতাকর্মীরা। পাশাপাশি বরিশালে নতুন প্রার্থী দেওয়াকে আওয়ামী লীগের চমক বলে দাবি করেছেন স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষকরা। একইসাথে সম্পূর্ণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সবধরনের প্রস্তুতি সম্পন্নের কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কর্মকর্তা।
সূত্রমতে, সাবেক মেয়র শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর বিভাগীয় শহর বরিশাল নগরীতে আওয়ামী লীগের হাল ধরে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি’র জেষ্ঠপুত্র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। পদ পেয়ে হয়ে যান মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, ভোটে নির্বাচিত হয়ে হন সিটি মেয়র। তবে আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নানা কারণে দ্বিতীয় মেয়াদে দলের মনোনয়ন পাননি সাদিক আব্দুল্লাহ। আসন্ন নির্বাচনে নৌকার টিকিট পেয়েছেন বর্তমানে মেয়রের আপন চাচা, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত।
মনোনয়ন বঞ্ছিত হওয়ার দুইদিন পর (১৯ এপ্রিল) বিকেলে বরিশাল নগরীর কালিবাড়ি রোডস্থ সেরনিয়াবাত ভবনে উপস্থিত মহানগর আওয়ামী লীগ, শ্রমিকলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মী এবং জনপ্রতিনিধিদের সাথে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে মতবিনিময় সভা করেন বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। যে সভাটি তার নিজস্ব ফেসবুক পেইজ থেকে লাইভে প্রচার করা হয়। ওই সভায় সাদিক আব্দুল্লাহ নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী আমার চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের শতভাগ বিজয় নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আমার চাচাকে। তাই আমরা এমন কোন কাজ করবো না, যাতে মাঝখান দিয়ে অন্য লোকজন ফয়দা নেয়। যারা লাফালাফি করছে তারা সুবিধাভোগী। এটা তারা করবেই, আর এটা স্বাভাবিক।
মেয়র সাদিক আব্দুল্লাহ আরও বলেন, আমরা মূলত অপেক্ষা করছি আমাদের রাজনৈতিক অভিভাবক (জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ এমপি) ঈদের পর পরই মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের যৌথ বর্ধিত সভা ডাকবে। ওইসভার পর সবাইকে একসাথে নিয়ে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে নির্বাচনী মাঠে নামা হবে।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাকে মনোনয়ন দিয়েছে, তার পক্ষেই নৌকার ভোট চাওয়া হবে। এখানে দ্বিধাবিভক্তি করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ¦ আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহর নেতৃত্বে বরিশাল আওয়ামী লীগ অতীতেও একাট্টা হয়ে নৌকার পক্ষে কাজ করেছে, আগামীতেও করবে।
বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, নেত্রী (শেখ হাসিনা) যাকে মনোনয়ন দিয়েছেন, তার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাই নৌকার পক্ষেই ভোটের লড়াইয়ে মাঠে নামবো।
বরিশালের উন্নয়ন সংগঠক রফিকুল আলম বলেন, সাবেক মন্ত্রী শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মতোই ক্লিন ইমেজের মানুষ খোকন সেরনিয়াবাত। তার মতো মানুষকে বরিশালের সিটি মেয়রের মনোনয়ন দেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের। এটি শেখ হাসিনার দূরদর্শী সিদ্ধান্ত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সনাকের জেলা সভাপতি অধ্যাপক শাহ্ সাজেদা বলেন, আওয়ামী লীগের মতো একটি ঐতিহাসিক দলের সকল কাজকর্ম গবেষণালব্ধ হয়। বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে প্রার্থী বাছাই যার বাস্তব উদাহরন। তিনি আরও বলেন, একজন সৎ মানুষকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এখন নির্বাচনও স্বচ্ছ হবে বলে নগরবাসী আশা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপি এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ঘোষণা দিয়েছেন। তবে দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, বিএনপি কৌশলে তাদের দলের সাবেক মেয়র প্রয়াত আহসান হাবীব কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপমকে নিয়ে মাঠে থাকবে।
এ ব্যাপারে ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও বিএনপি দলীয় সাবেক মেয়র কামালের ছেলে কামরুল আহসান রুপম বলেন, বিএনপির স্থানীয় ও জাতীয় নেতাদের সাথে কথা হয়েছে। ভোট কতোটা সুষ্ঠু হয় সেটাই প্রমাণ করতে হাইকমান্ডের সিগনালেই আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হবো। কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করে রুপম বলেন, আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি এইটা আওয়ামী লীগের কতিপয় নেতা চায় না। তা না হলে আমি মাঠে নামার দুইদিনের মধ্যেই দুদক দিয়ে আমার সম্পদের হিসেব চাওয়া হতোনা।
বিএনপির সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক (বরিশাল বিভাগ) অ্যাডভোকেট বিলকিস জাহান শিরিন বলেন, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না তাদের দল। বিগতদিনে উপজেলার কোনো নির্বাচনেও বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি। কারণ এ সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন হবেনা।
অপরদিকে বরিশাল সিটি কপোরেশনের নির্বাচনে শক্তিশালী অবস্থান দেখাতে প্রার্থী দিবেন ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ। এ ব্যাপারে দলের যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র গাজী আতাউর রহমান বলেন, আমাদের দল থেকে পাঁচটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনেই প্রার্থী দেওয়া হবে। এ ছাড়া আমাদের সংগঠন গড়ে উঠেছে বরিশাল শহরের ওপর। তাই সিটি নির্বাচনে বরিশালের বিষয়ে আমাদের নজর বেশি থাকবে। সেক্ষেত্রে বরিশালে আমাদের প্রভাব আরও বাড়াতে হাত পাখার শক্তিশালী প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হবে। গাজী আতাউর রহমান আরও বলেন, বরিশাল সিটি নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে দলের নায়েবে আমির মুফতী সৈয়দ ফয়জুল করিমের প্রতি নগরবাসীর চাহিদা বেশি। কিন্তু এটি স্থানীয় নির্বাচন এবং উনি (ফয়জুর করিম) জাতীয় নেতা। তাকে নিয়ে জাতীয় নির্বাচনে আমরা বড় কিছু ভাবছি। তাই সবকিছু বিবেচনা করে আসন্ন ঈদ-উল ফিতরের পর পরই আমাদের দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হবে।
এছাড়া জাতীয় পার্টি (জাপা) থেকে আগে ভাগেই বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে মনোনয় দেওয়া হয়েছে জাতীয় পাটির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা সদস্য সচিব প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন তাপসকে। তিনি (তাপস) বলেন, নগরবাসীর সেবা করার জন্যই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবো। দল থেকে আমাকে আগাম মনোনায়ন দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে বিজয় সুনিশ্চিত হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বরিশালের মানুষ উন্নয়ন চায়, আর বরিশালের উন্নয়নের জন্য আমি কাজ করতে চাই।
এসবের বাহিরে গত সিটি নির্বাচনে দেশব্যাপী আলোচনায় থাকা একমাত্র নারী প্রার্থী বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী এবারেও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মনীষা চক্রবর্তী বলেন, আমাদের দল ঐক্যবদ্ধভাবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সেক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. আলাউদ্দীন বলেন, সিটি করপোরেশনের ৩০টি ওয়ার্ডের ১২৪টি ভোট কেন্দ্রের ভেতরে-বাহিরে ও সব বুথে সিসি ক্যামেরা দিয়ে নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়ম করতে দেওয়া হবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
সবমিলে ইফতার, কিংবা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকা-ে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ধারণা করা হচ্ছে আসন্ন ঈদ-উল ফিতরের পর পরই পুরোদমে সরগরম হয়ে উঠবে ভোটের মাঠ। ২ লাখ ৭৪ হাজার ৯৯৫ ভোটার আগামী ১২ জুন নির্ধারণ করবেন কে বসবে বরিশাল নগর ভবনে মেয়রের চেয়ারে কিংবা কারা হবেন কাউন্সিলর।