আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা বরিশাল নগরীতে এসে সিটি নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রীর মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থীর প্রধান নির্বাচনী কার্যালয় উদ্বোধণ করেছেন। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানেও যোগ দেয়নি বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ও তার অনুসারি মহানগর এবং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মীরা।
জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় নেতা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলেও বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা এখনও সাদিক আব্দুল্লাহর নির্দেশের অপেক্ষায় নির্বাচনী মাঠে নামেননি। শুক্রবার বিকেলে প্রধান নির্বাচনী কার্যালয়ের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আলহাজ আমির হোসেন আমু এমপি, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহঙ্গীর কবির নানক, পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম এমপি, বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাংসদ অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস, মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট একেএম জাহাঙ্গীর হোসেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিমসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
সাদিকপন্থিদের অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়াকে ঘিরে নগরীতে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। বিভিন্ন ওয়ার্ডের সাদিকপন্থি আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ব্যক্তিগতভাবে তাদের আমন্ত্রণ জানানো হলেও দলীয়ভাবে তারা আমন্ত্রণ পাননি। তাই বেশিরভাগ নেতাকর্মীরা উদ্বোধণী অনুষ্ঠানে যাননি। সাদিক অনুসারী মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নিগার সুলতানা হনুফা বলেন, দলীয়ভাবে আমাদের ওই অনুষ্ঠানে সম্পর্কে কোনো কিছু জানানো হয়নি। ফলে আমরা সেখানে যাইনি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা ডেকে নির্বাচন পরিচালনা ও প্রচারণার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত দেবেন সেই অনুযায়ী আমরা মাঠে নামবো। তিনি আরও বলেন, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নৌকা প্রতীক দিয়েছেন। সেখানে নৌকার বিরোধীতা করার কোনো সুযোগ নেই।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউসুন বলেন, নির্বাচন পরিচালনার প্রধান কার্যালয় উদ্বোধনের জন্য আমন্ত্রণ পেয়ে আমি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছি। তবে নগরীতে বসবাসকারী অধিকাংশ জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতাদের অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, খুব শীঘ্রই জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বার্ধিত সভায় সিটি নির্বাচনে নৌকার পক্ষে প্রচারণার কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হবে। এরপর দেখা যাবে কে নির্বাচনী মাঠে নেমেছে আর কে কোথায় রয়েছে।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়েছেন। তারস্থলে মনোনয়ন পেয়েছেন সাদিক আব্দুল্লাহর একমাত্র চাচা আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাত। তিনি (খোকন সেরিনয়াবাত) সাদিক বিরোধী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সমর্থিত প্রার্থী। যেকারণে সাদিকপন্থিরা বর্তমানে নগরীতে অনেকটাই কোণঠাসা হয়ে রয়েছেন।
উদ্বোধণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু বলেছেন, সিটি করপোরেশন নির্বাচন একটি মামুলি নির্বাচন নয়। আর কয়েক মাস পরেই হবে জাতীয় নির্বাচন। সেই নির্বাচনকে সামনে রেখে অনেক জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের মধ্যদিয়ে শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন; মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন করছেন। আজ তার হাতকে শক্তিশালী করতে হলে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে জয়যাত্রা সুনিশ্চিত করতে হলে, সিটি নির্বাচনে জয়যাত্রা দিয়ে শুরু করতে হবে।
সাবেক এই মন্ত্রী আরও বলেন, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সুযোগ্য পুত্র ১৫ আগস্টে গুলিবিদ্ধ আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে বরিশাল নগরবাসীর জন্য ঈদের উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার এই উপহারকে সবাই গ্রহণ করার মাধ্যমে আগামী ১২ জুনের নির্বাচনে নৌকা মার্কাকে বিজয়ী করে প্রধানমন্ত্রীকে বিজয় উপহার দেবেন।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আদরের ভাই, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে নৌকা মার্কায় বিজয়ী করলে প্রধানমন্ত্রী বরিশাল নগরীকে আধুনিকায়ন করে দেবেন। পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কর্নেল (অব.) জাহিদ ফারুক শামিম এমপি বলেন, নৌকা হচ্ছে উন্নয়নের প্রতীক। বরিশাল নগরবাসীকে সাথে নিয়ে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নৌকার বিজয় সুনিশ্চিত করতে সবাইকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে। আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা মার্কার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যে আশা আকাক্সক্ষা নিয়ে আমাকে মেয়র পদে মনোনয়ন দিয়ে বরিশালে পাঠিয়েছেন, আমি তার শতভাগ মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট থাকবো। নগরবাসী তাদের মূল্যবান ভোটের মাধ্যমে আমাকে নির্বাচিত করলে আমি বরিশাল নগরীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা করে তিলোত্তমা স্মার্ট শহরে রূপান্তরিত করবো।
নিজ দলে বিভাজন ॥ বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসলেও আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবুল খায়ের আব্দুুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতের পক্ষে এখনও প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে নামেননি মহানগর, জেলা ও অধিকাংশ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ওইসব নেতাকর্মীদের দাবি, বর্তমান মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ দীর্ঘদিন থেকে ঢাকায় অবস্থান করছেন। ঈদের আগে তিনি ভার্চুয়ালে মহানগর এবং ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতাদের সাথে কথা বলেছেন। ওইসময় তিনি (সাদিক) বলেছেন, জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যৌথভাবে বর্ধিত সভা করে নির্বাচনী মাঠে নামার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। তাই তারা এখন প্রকাশ্যে ভোটের মাঠে নামতে পারছেন না।
তবে দলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে জানা গেছে, নৌকার প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাতকে সমর্থনের বিষয়টি এখনই প্রকাশ্যে আসলে পদ-পদবী হারানোর ভয়ে মহানগর আওয়ামী লীগ এবং ৩০টি ওয়ার্ড কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেদের অনেকটা আড়ালে রেখেছেন। এমনই পরিস্থিতিতে গত ২৪ এপ্রিল রাতে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেছেন মেয়র প্রার্থী খোকন সেরনিয়াবাত। মেয়র প্রার্থীর ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, নির্বাচনী কার্যক্রমে স্থানীয় আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাদের অসহযোগিতার বিষয়টি দলীয় প্রধানকে জানানো হয়েছে। পাশাপাশি মেয়াদোত্তীর্ণ মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে দেয়ার জন্যও অনুরোধ করা হয়েছে। কেননা মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটি থাকায় ওয়ার্ডের নেতাকর্মীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারছেন না। তাদের মধ্যে ভয়, জড়তা আর আনুগত্য কাজ করছে।
দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন হিরণের পরাজয়ের পেছনে দলের একটি অংশের বিশ্বাস ঘাতকতা রয়েছে। এ কারণে অতীতের কথা স্মরণ করে খোকন সেরনিয়াবাতের অনুসারীরাও এবার নৌকার বিজয়ের ব্যাপারে বেশ শঙ্কা প্রকাশ করছেন। তারা মনে করছেন, কেন্দ্রের চাপে স্থানীয় কতিপয় নেতা তার অনুসারীদের নিয়ে ভোটের মাঠে নামলেও তাদের ওপর বিশ্বাস রাখা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এ ব্যাপারে বিএম কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক ভিপি মঈন তুষার বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির কতিপয় দায়িত্বশীল ব্যক্তি নেতাকর্মীদের চাঁপের মুখে রেখেছেন। ফলে ভয়ে নেতাকর্মীরা নৌকার প্রার্থীর পক্ষে প্রকাশ্যে সামনে আসতে পারছেন না। যেকারণে এই কমিটি থাকলে ২০১৩ সালের সিটি নির্বাচনের মতো এবারও ট্র্যাজেডি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের বরিশাল মহানগর শাখার সভাপতি একে আজাদ ফারুক বলেন, আমার পাশের এলাকার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি জসিম উদ্দিনকে ভোটের মাঠে নামতে বলেছিলাম। কিন্তু জসিম আমাকে জানিয়েছে, তারা সাদিক আব্দুল্লাহর অপেক্ষায় আছেন। আসলে নগর এবং ওয়ার্ড কমিটির নেতারা তাদের পদ হারানোর ভয়ে এখনো প্রকাশ্যে সামনে আসছেন না।
অপরদিকে নগরীজুড়ে গুঞ্জন উঠেছে সিটি নির্বাচনের আগেই মহানগর আওয়ামী লীগের কমিটি ভেঙে আহ্বায়ক কমিটি গঠণ হতে পারে। এ ব্যাপারে মহানগর আওয়ামী লীগের বর্তমান সহসভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, সম্মেলন অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদনের সূত্রে মেয়াদ এখনও শেষ হয়নি।
উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ১২ জুন বরিশাল সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ করা হবে। এখানকার বর্তমান মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ খোকন সেরনিয়াবাতকে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা ইঞ্জিনিয়ার ইকবাল হোসেন তাপসকে। পাশাপাশি চরমোনাই পীরের ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশ মনোনীত প্রার্থী হয়েছেন দলের কেন্দ্রীয় সিনিয়র নায়েবে আমীর মুফতী সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করীম। তবে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি ও বাসদ। তবে সিটি করপোরেশনের বিএনপি দলীয় সাবেক মেয়র প্রয়াত আহসান হাবিব কামালের ছেলে সাবেক ছাত্রদল নেতা কামরুল আহসান রুপন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবেন বলে জানিয়েছেন।