দেশে পেঁয়াজ চাহিদার চেয়ে বেশি উৎপাদন হলেও আমদানি করতে হচ্ছে প্রতি বছরই। চলতি বছর ২ লাখ ৪১ হাজার ৯০০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে ৯৮ শতাংশ জমিতে পেঁয়াজের ফলন হয়েছে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার টন। গত অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ৩৬ লাখ ৪১ হাজার টন। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে পেঁয়াজ আবাদ হয় ২ লাখ ১২ হাজার হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৫৯ হাজার হেক্টর। এ সময়ের মধ্যে কৃষিপণ্যটির উৎপাদনশীলতা হেক্টরপ্রতি ১১ টন থেকে বেড়ে ১৪ টনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ বছর কয়েকটি জেলায় ভেজাল বীজের কারণে পেঁয়াজের চারা কম গজানো ও গজানোর পর মরে যাওয়ায় কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আর পূরণ হয়নি পেঁয়াজের লক্ষ্যমাত্রাও। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর ও পেঁয়াজ চাষীদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২৫ লাখ টন। এ বছর এখন পর্যন্ত ৯৮ শতাংশ জমির পেঁয়াজ তোলা হয়েছে। ফলন হয়েছে ৩২ লাখ ৯৬ হাজার টন। তবে এপ্রিলের শুরুতে বৃষ্টি হওয়া ও বীজের মধ্যে কয়েকটি জাতের মিশ্রণ থাকায় ফলন কমেছে। তাছাড়া এরইমধ্যে অনেক কৃষকের পেঁয়াজ পচে যাচ্ছে। সাধারণত মার্চ ও এপ্রিলে কৃষকরা পেঁয়াজ তুলে রোদে শুকিয়ে দেশীয় পদ্ধতিতে মাচা তৈরি করে সংরক্ষণ করে এবং জুন থেকে জুলাই পর্যন্ত বাজারে বিক্রি হয়। এতে পেঁয়াজের ওজন ৩০-৩৫ শতাংশ কমে। তবে এ বছর এপ্রিলের শুরুতে বৃষ্টি হওয়া ও বীজের মধ্যে কয়েকটি জাতের মিশ্রণ থাকায় যেমন ফলন কম হয়েছে, তেমনি স্থানীয়ভাবে সংরক্ষণ করা যাচ্ছে না। কৃষকরা বলছেন, এ পেঁয়াজ রেখে দিলে জুন পর্যন্ত ৭০ শতাংশই পচে যাবে। বাধ্য হয়েই কৃষক এখনই পেঁয়াজ বিক্রি করে দিচ্ছে। তাতে আবারো দেশের বাজারে পেঁয়াজের সংকটের আশঙ্কা থাকে। সূত্র জানায়, রাজবাড়ী জেলা পেঁয়াজ উৎপাদনে দেশে অন্যতম। কিন্তু অসাধু চক্রের কারসাজিতে ভেজাল বীজে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ বছর ওই জেলায় ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। জেলায় হালি পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য ২০০ টন বীজ প্রয়োজন হলেও উৎপাদন হয় ৮০ টন। বাকি ১২০ টন ঘাটতি থাকে, যা পাশের জেলাগুলো থেকে পূরণ করা হয়। এ সুযোগে অসাধু বীজ ব্যবসায়ীরা ভেজাল দেয়ার সুযোগ নিয়েছে। এ বছর হালি পেঁয়াজ রোপণে ভেজাল বীজে ক্ষতি এবং বৃষ্টিতে পেঁয়াজ নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া মেহেরপুরের কয়েকটি উপজেলায় কৃষকরা ভারতীয় অতিরিক্ত উচ্চফলনশীল (উফশী) বীজ ক্রয় করেও প্রতারিত হয়েছেন। তাছাড়া প্রতি বছরের মতো নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণে রাখা পেঁয়াজ হঠাৎই ঈদের আগে থেকে পচে যাচ্ছে। ফলে অনেক চাষীবা কম মূল্যে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছে, আবার অনেকেই পচে যাওয়া পেঁয়াজ ফেলে দিয়েছে। এর প্রভাবে আগামী দিনে পেঁয়াজের দাম বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সূত্র আরো জানায়, দেশে পেঁয়াজ উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে গত কয়েক বছরে পেঁয়াজ আমদানি কিছুটা কমেছে। তবে সংরক্ষণ দুর্বলতায় উদ্বৃত্তের সুফল ভোগ করা যাচ্ছে না। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৮ লাখ ৬৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে করা হয় ১০ লাখ ৭ হাজার টন। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫৩ হাজার টন ও ৬ লাখ ৬৫ হাজার টনে। আমদানীকৃত পেঁয়াজের প্রায় পুরোটাই ভারতীয়। আর ভারতের বাণিজ্য বিভাগের তথ্যমতে, ২০২১-২২ অর্থবছরে ভারত থেকে ৬ লাখ ৫৮ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি করা হয়েছে। আর ২০২২ সালে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে আমদানি করা হয়েছে ৫ লাখ ১০ হাজার টন। তদাছাড়া গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর ছয় মাসে ৭ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের পেঁয়াজ আমদানি করেছে বাংলাদেশ। এর মধ্যে জুলাইয়ে ১ কোটি ২৯ লাখ ডলার, আগস্টে ১ কোটি ৬১ লাখ, সেপ্টেম্বরে ১ কোটি ৫৮ লাখ, অক্টোবরে ১ কোটি ৩২ লাখ, নভেম্বরে ১ কোটি ২৬ লাখ ও ডিসেম্বরে ৮১ লাখ ডলারের পেঁয়াজ আমদানি করা হয়। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আসিফ রেজা অনিক জানান, এ বছর ভেজাল বীজের কারণে একটা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। কৃষক পেঁয়াজ তুলে দেখেছেন ১২-১৫টায় এক কেজি হয়ে যাচ্ছে। সাধারণত ফরিদপুর বা আশপাশের জেলাগুলোতে এ জাতের পেঁয়াজ কৃষকরা চাষ করেন না। বীজের মধ্যে হয়তো মিশ্রণ রয়েছে। তবে সার্বিকভাবে পেঁয়াজ উৎপাদনের সুফল পেতে হলে আমাদের তথ্যের ক্ষেত্রে আরো শক্তিশালী হতে হবে। তথ্য সংগ্রহকারী সংগঠনগুলোর মধ্যে তথ্যের অনেক তফাত থাকে। এ কারণে সঠিকভাবে পলিসি নেয়া যায় না। সঠিক তথ্য পেলে বছরে কতটুকু আমদানি করতে হবে বা কখন করতে হবে সেটার সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। আর ভেজাল বীজ ঠেকাতে মনিটরিং বাড়াতে হবে। যারা ভেজাল বীজ কৃষকদের হাতে তুলে দিচ্ছে তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।