অনুকূল আবহাওয়া, চাহিদা ও ভালো ফলনের পাশাপাশি অল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় আনারস চাষে ঝুঁকছেন লালমনিরহাটের চাষিরা। এ কারণে চলতি বছরে লালমনিরহাটে আনারসের বাম্পার ফলন হয়েছে। আনারসের পাশাপাশি একই জমিতে অন্য ফসলেও বাড়তি মুনাফা করছেন তাঁরা।
কৃষকদের মতে, ভালো ফলন পেতে মাটি ঝরঝরে করে মই দিয়ে জমি সমতল করতে হয়, যাতে বৃষ্টির পানি কোন স্থানে জমে না থাকতে পারে। আনারস চাষের জমিতে যতটুকু সম্ভব জৈব সার প্রয়োগ করতে হয়। মাটি পরীক্ষা করে মাটির ধরণ অনুযায়ী সার প্রয়োগ করলে ফলন ভাল হয়। তারপর জমি থেকে ১৫ সে.মি. উঁচু এবং এক মিটার প্রসস্থ বেড তৈরি করতে হয়। এক বেড থেকে অপর বেডের ৫০-১০০ সে.মি. দূরত্ব রাখতে হয়। এক মিটার প্রসস্থ বেডে দুই সারিতে চারা রোপণ করতে হয়। প্রত্যেক সারির দূরত্ব ৫০ সে.মি. এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ৩০-৪০ সে.মি.।
চাষীরা জানায়, আনারস গাছ থেকে কুড়ি ভেঙ্গে বিভিন্ন ধরনের চারার মাধ্যমে আনারসের বংশবিস্তার করা হয়ে থাকে। চারার বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে রয়েছে পার্শ্ব চারা, বোঁটার চারা, মুকুট চারা ও গুঁড়ি চারা ইত্যাদি। এর মধ্যে পার্শ্ব চারা বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য সবচেয়ে ভালো।
ফুলগাছ এলাকার এক স্কুল শিক্ষক নুরুল হাসান জানান, আমি সরকারী চাকুরির পাশাপাশি বিভিন্ন সবজি ও ফল চাষ করি। এবছরও প্রায় ৫ বিঘা জমি সবজি চাষের জন্য প্রস্তুত করেছি। এর মধ্যে ২-৩ বিঘা জমিতে টাঙ্গাইল মধূপুর থেকে নিয়ে আসা আনারসের কিছু চারা রোপন করেছি। বাকী জমিতে চারা রোপন করবো ভাবছি। লালমনিরহাট জেলার মাটি আনারস চাষের জন্য মোটামুটি উপযোগী। তাই আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বাম্পার ফলনের আশা করছি। বাম্পার ফলন হলে আর্থিক ভাবে লাভবানও হবো ইনশা আল্লাহ।
তিনি আরো বলেন, আনারস চারা একটু বড় হলে পোকার আক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। নিজস্ব উৎপাদিত জৈব কীটনাশক ব্যবহার করে পোকা দমন করা সম্ভব না হলে স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শ নিয়ে পোকার আক্রমণ থেকে আনারস চারা রক্ষা করা যেতে পারে।
আনারস চাষি মোঃ আবদুল হামিদ মিঞা বলেন, আমার লিচু বাগানের জমিতে আনারসের চাষ করেছি। এখন পর্যন্ত বিক্রয় উপযোগী হয়নি আনারস।
মোঃ হযরত আলী নামে এক চাষী বলেন, কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসে আনারসের চারা রোপণ করতে হয়। এক বছরের মাথায় আনারসের ফলন আসতে থাকে এবং দেড় বছরের মাথায় বাগানের সব আনারস বিক্রি করে শেষ করা হয়। একই জমিতে আনারসের পাশাপাশি অন্য ফসলও আবাদ করে বাড়তি আয় হয়। এজন্য আনারস বাগানে নিয়মিত ইউরিয়া, পটাশ, টিএসপি, জিপসাম ও জৈব সার প্রয়োগ করলে আর বেশি পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। মাঝে মধ্যে পচন রোগের আক্রমণ হলে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শে সমাধান পাওয়া যায়।
ফুলগাছ ব্লকের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা শহীদুল ইসলাম খন্দকার বলেন, প্রতিটি বাড়ির উঠানের জমিতে কম আর বেশি আনারসের চাষ হয়। চাষিরা নিজের চাহিদা মিটিয়ে বাজারেরও বিক্রি করতে পারেন।
তিনি আরও বলেন, আনারসের বেশ কয়েকটি জাতের মধ্যে হানিকুইন উল্লেখযোগ্য। হানিকুইন ডলডুপি হিসেবেও পরিচিত। চোখ সূচালো ও উন্নত। গড় ওজন প্রায় ১ কেজি। পাতা কাঁটাযুক্ত ও পাটল বর্ণের। হানিকুইন বেশ মিষ্টি আনারস অনেকটা রসালো। পাকা আনারসের শাঁস হলুদ রঙের। সবচেয়ে বড় আকারের জাত হচ্ছে জায়ান্টকিউ। নামের সাথে মিল রেখেই এর আকারও বেশ বড়। পাকা অবস্থায়ও এ আনারসের রং সবুজাভ শাঁস হালকা হলুদ। চোখ প্রসস্থ ও চেপ্টা। গাছের পাতা সবুজ ও প্রায় কাটাবিহীন। গড় ওজন ২ কেজি। অপর আরেকটি জাত হলো ক্যালেন্ডুলা। এটি মাঝারি আকৃতির এবং খেতেও মিষ্টি। ওজন ১ থেকে দেড় কেজি। আরও একটি উল্লেখযোগ্য জাত হচ্ছে ঘোড়াশাল। পাকা আনারস লালচে এবং ঘিয়ে সাদা হয়। চোখ প্রসস্থ। পাতা কাঁটা বিশিষ্ট, চওড়া ও ঢেউ খেলানো থাকে। গড় ওজন ১ থেকে ১.২৫ কেজি। এগুলো ছাড়া দেশীয় আরও কয়েকটি জাত আছে যেগুলো বাড়ির আঙিনার আশপাশে রোপন করা যায়। এ ব্যাপারে লালমনিরহাট কৃষি অফিসের আয়োজনে চাষীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এইসব আনারস চাষে উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।