মহাকালের বিস্তীর্ণ পটভূমিতে এক ব্যতিক্রমী রবির কিরণে উজ্জ্বল পঁচিশে বৈশাখ। ১৮৬১ সালের এদিনে কলকাতার জোড়াসাঁকোয় মহর্ষী দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ঘর আলো করে জন্ম নিয়েছিলেন বাঙালির কবি- বাংলার কবি, বিশ্বকবি, কবিগুরু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পঁচিশে বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬৩তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দের বাংলা ২২ শ্রাবণ মৃত্যুবরণ করলেও বাংলা ভাষার প্রধানতম কবি হয়ে বাঙালির হূদয়ে চির আসন করে নিয়েছেন। প্রতিবছর বৈশাখ মাসের ২৫ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে এই উৎসব পালন করা হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সহ আরো অন্যান্য রাজ্যে এবং বাংলাদেশে ও বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে এই রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব পালন করা হয়। আমাদের কাছে রবীন্দ্র জয়ন্তী অথবা ২৫ শে বৈশাখ বাঙালি জাতির কাছে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সংস্কৃতিক উৎসব। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের জন্য রেখে গিয়েছেন অমূল্য সব সম্পদ গুলি। তার কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, যা জীবনে চলার পথে প্রতিমুহূর্তে আমাদের প্রয়োজন পড়ে। রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় ও দার্শনিক চেতনা ছিল- শুধু নিজের শান্তি বা নিজের আত্মার মুক্তির জন্য ধর্ম নয়। মানুষের কল্যাণের জন্য যে সাধনা তাই ছিল তার ধর্ম। তার দর্শন ছিল মানুষের মুক্তির দর্শন। মানবতাবাদী এই কবি বিশ্বাস করতেন বিশ্বমানবতায়। জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার কবিতায়, গানে, গল্পে, বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সেই দর্শনের অন্তেষণ করেছেন তিনি। তার কবিতা, গান, সাহিত্যের অন্যান্য শাখার লেখনী মানুষকে আজো সেই অন্তেষণের পথে, তার অন্বিষ্ট উপলব্ধির পথে আকর্ষণ করে।
রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মন-মানসিকতা গঠনের, চেতনার উন্মেষের অন্যতম প্রধান অবলম্বন। বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিশ্বজনীন হয়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের মাধ্যমে। বাংলা সাহিত্যকে তিনি বিশ্বের দরবারে সম্মানের আসনে পৌঁছে দিয়েছেন। তার হাতেই বাংলা ভাষায় প্রথম সার্থক ছোটগল্পের সৃষ্টি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখতে শুরু করেন ৮ বছর বয়সে। আটপৌরে বাঙালির মতো তার শুরুটা হয়েছিল ছড়া দিয়ে, যা পূর্ণাঙ্গতা পায় কবিতায়। একদিন সেই কবিতাই তাকে তুলে ধরে বিশ্ব দরবারে। তিনি হয়ে ওঠেন বিশ্বকবি। বাংলা উপন্যাসকে তিনি আধুনিক ও সার্থক উপন্যাসে তুলে এনেছেন। শুধু সৃজনশীল সাহিত্য রচনায় নয়, অর্থনীতি, সমাজ, রাষ্ট্র নিয়ে তার ভাবনাও তাকে অত্যন্ত উঁচু স্থানে নিয়ে গিয়েছে। তাঁর লেখা গান বাঙালির হূদয়ে প্রতিধ্বনিত হয় আজো। বাংলাদেশের মানুষের কাছে রবীন্দ্রনাথ প্রেরণাদায়ী পুরুষ। যে কোন রাজনৈতিক অস্থিরতায়, আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা, গান আন্দোলনরত মানুষদের দেখায় পথের দিশা। রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব উদযাপনের অঙ্গ হল রবীন্দ্রসংগীতানুষ্ঠান, নৃত্যানুষ্ঠান, রবীন্দ্রনাট্যাভিনয়, রবীন্দ্ররচনাপাঠ, আলোচনাসভার আয়োজন ও নানাবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত ভবনগুলিতে এই সময় বিশেষ জনসমাগম দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রধান অনুষ্ঠানগুলি আয়োজিত হয় কলকাতায় অবস্থিত কবির জন্মস্থান জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি ও রবীন্দ্রসদন এবং শান্তিনিকেতনে। বাংলাদেশে সর্বত্র ছোট-বড় নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপিত হয়। এ ছাড়া শিলাইদহ কুঠিবাড়ি ঘিরেও একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়ে থাকে। সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বহির্বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বসবাসকারী বাঙালিরাও এই উৎসব পালন করেন এবং পশ্চিমবঙ্গে এই দিনটি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ নিজের জীবদ্দশায় নিজের জন্মদিন উদযাপন নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিলেন না। তাই ২৬ বছর বয়সে তার প্রথম জন্মদিন উদযাপিত হয়। তারপরও কবির জন্মদিন আরও ২২ বছর ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলের আড়ালে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে কবি তার বিশ্বজোড়া গুণগ্রাহীদের আকুল আবেদন ফেরাতে পারেননি। ভক্তদের কাছে হার মেনেছেন কবি। কবির জীবদ্দশায় রবীন্দ্রজয়ন্তী প্রথম উদযাপিত হয় ১৮৮৭ সালে। রবীন্দ্রজয়ন্তী সাড়ম্বরে প্রথমবার পালিত হয়েছিল ১৯১২ সালে। সে বছর ৫০ পূর্ণ করে ৫১ তে পা দিয়েছেন কবি। রবীন্দ্রজয়ন্তীকে সফল করতে শান্তিনিকেতনের আশ্রমিকদের সঙ্গে প্রশান্ত মহলানবিশের নেতৃত্বে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা থেকে বেশ কিছু গুণীজন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন, সত্যেন দত্ত, সুকুমার রায় ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। বেদণ্ডউপনিষদ পাঠ করে এবং মালা পরিয়ে কবিকে বরণ করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের এক মহান প্রাণপুরুষ, যার অস্তিত্ব কখনো মুছে ফেলা যাবে না। যেমনটা যায়নি ইংরেজি সাহিত্যে শেক্সপিয়ারকে। রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে নক্ষত্র আলো ছড়াতে থাকবে সমগ্র সৃষ্টিব্যাপী। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আছেন এবং সদা থাকবেন আমাদের হৃদয় গহীনে।