সোনালি ধানে হাসছে দেশের উত্তরের জেলা দিনাজপুরের হাকিমপুর হিলি উপজেলার বিস্তীর্ন মাঠ। খাদ্য শস্য ভান্ডার হিসেবে পরিচিত এই জেলার হাকিমপুর হিলি উপজেলার চারদিকে এখন উৎসব মুখর পরিবেশে ধান কাটা মাড়াই চলছে। ধানের বাম্পার ফলন হওয়ায় খুশি এখানকার কৃষকরা। উপজেলায় শ্রমিকের পাশাপাশি সরকারি ভর্তূকি দিয়ে পাওয়া কম্বাইন হারভেস্টার মেশিনের (ধান কাটার মেশিন) সাহায্যে ধান কাটা হচ্ছে। ফলে ধান কাটতে শ্রমিক সংকট পড়েনি। তবে বাজারে ধানের দাম বৃদ্ধির দাবি বর্গাচাষীদের। ধান বিক্রয় করে খরচ তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছে বর্গাচাষীরা।
উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত উপজেলার প্রায় ৬৫-৭০ শতাংশ ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। আগামী এক দুই সপ্তাহের মধ্যেই শতভাগ ধান কাটা হয়ে যাবে বলে আশা তাদের। সেই সাথে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানা'র আগে যেসব জমির ধান আশি ভাগ পেকে গেছে সেই সব জমির ধান তাড়াতাড়ি কাটা'র পরামর্শ দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষি অফিস।
বুধবার (১০ মে) উপজেলার বিভিন্ন উন্নয়ন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-সূত্রে জানা গেছে, চলতি মৌসুমে উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় ৭ হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তার বিপরীতে এবার চলতি বোরো মৌসুমে ৭ হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ করা হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান কৃষি অফিস।
উপজেলার আলিহাট, বোয়ালদাড় ও পৌরসভা ঘুরে সরেজমিনে দেখা গেছে, উপজেলায় শ্রমিকদের পাশাপাশি কম্বাইন হারভেস্টার দিয়ে পুরোদমে বোরো ধান কাটা চলছে। চলছে মাড়াই খর শুকানোর এর কাজ। পাশপাশি কিষাণিরা ধান মাড়াই করে শুকিয়ে গোলায় তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। কৃষক-শ্রমিকদের কেউ ক্ষেত থেকে ধান কেটে টানছেন, কেউ রোদে ধান শুকানোর কাজ করছেন, কেউ মেশিন দিয়ে ধান কাটা-মাড়াইয়ে ব্যস্ত, কেউ কেউ সনাতন পদ্ধতিতে ধান মাড়াই-ঝাড়াইর কাজে করছেন। তবে কিষাণী ও মহিলা শ্রমিকদের ধান সিদ্ধ শুকনা ও বোরো ধানের খড় শুকানো কাজে ব্যাস্ত থাকতে দেখা গেছে।
স্থানীয় একাধিক কৃষক জানান, এবারে চলতি বোরো মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরো ফসলের ফলন ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজারে ধানের দাম ভালো না থাকায় দুশ্চিন্তায় বর্গাচাষিরা। তবে ধান কাটা ও মাড়াই এ কোনো ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। এমনকি শ্রমিক সংকটও পড়েনি।
উপজেলার আলিহাট ইউনিয়নের কোকতাড়া গ্রামের কৃষক মিজানুর রহমান ও মাহাবুর রহমান বলেন, আবহাওয়া অনূকূলে থাকায় এবারে বোরোর ফলন ভালো হয়েছে। বর্তমানে আমাদের প্রায় অর্ধেকের মতো ধান কাটা মাড়াই করা শেষ হয়েছে। এখন কেউ কেউ ধান সিদ্ধ শুকনো ও খড় শুকানোর কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছে। আমাদের এখানে প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) ধান কাটা ও মাড়াই শ্রমিক মজুরি দিতে ৩২০০ থেকে ৩৫০০ টাকা। আর মেশিন দিয়ে কাটলে প্রতি বিঘা ২০০০ টাকা। বাজারে চিকন ধান প্রতি মণ বিক্রি হচ্ছে ১০৫০ থেকে ১১০০ টাকা। প্রতি বিঘা ধানের ফলন হচ্ছে ২০-২২ মণ। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে। আমাদের সব নিজের জমি তাই খরচ খরচা বাদ দিয়ে বিঘা প্রতি ৫-৬ টাকা লাভ হবে। আর এক সপ্তাহ আবহাওয়া ভালো থাকলে ধান কাটা মাড়াই এর কাজ প্রায় শেষ হবে বলে আশা তাদের।
উপজেলার বোয়ালদাড় ইউনিয়নের বিশাপাড়া গ্রামের কৃষক কাওসার রহমান বলেন, অন্যর জমি বর্গানিয়ে ৮ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। ধানের বাম্পার ফলনে আমি খুশি। কিন্তু এবারে খরচ অনেক বেশি। ধান চাষের আগেই বিঘা প্রতি জমির মালিককে ১০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। এরপর জমি তৈরি, রোপণ, সার ও কীটনাশক এর জন্য বিঘা প্রতি খরচ হয়েছে প্রায় দশ হাজার টাকা। জমিতে পানি সেচ এক হাজার টাকা। বর্তমানে ধান কাটা ও মাড়াই প্রতি বিঘা চার হাজার টাকা। প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) ধান হচ্ছে ২০-২২ মণ। যা বাজারে বিক্রি করলে খরচ উঠছে না। কারণ বাজারে প্রতি মণ ধান বিক্রি হচ্ছে এক হাজার থেকে এক হাজার একশ টাকা। বাজারে সব জিনিসের দাম বেশি তাই খরচ তোলা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। যার ফলে টাকা বেশি লাগলেও শ্রমিক দিয়ে ধান কাটা ও মাড়াই করে নিচ্ছি। পরে খড় শুকিয়ে নিবো এটাই আমার মতো বর্গাচাষী কৃষকদের লাভ। পরবর্তীতে এই খড়গুলো ভালো দামে বিক্রি করা যায়। আমাদের এলাকায় প্রায় অর্ধেক জমির ধান কাটা ও মাড়াই শেষ হয়েছে।
পৌরসভার চন্ডিপুর এলাকার কৃষক রিপন বসাক বলেন, নিজের গভীর নলকূপ আছে প্রতি বছরের ন্যায় এবারেও ২০-২২ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছি। কাটা মাড়াই প্রায় অর্ধেকের বেশী শেষ হয়েছে। মেশিন দিয়ে ধান কাটা মাড়াই শেষে বস্তায় প্যাকেট করে নিয়েছি। এতে প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) খরচ হয়েছে ২ হাজার টাকা। এতে সময় কম লেগেছে কিন্তু খড় জমিতে রয়েছে। খড়গুলো পরবর্তীতে জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার হবে। আমার লোকসান নাই। আমার প্রায় অর্ধেকের বেশি জমির ধান কাটা হয়েছে। যেসব জমির ধান আশি ভাগ পেকে গেছে সেই সব জমির ধান তাড়াতাড়ি কাটার পরামর্শ দিচ্ছেন কৃষি অফিস।
এদিকে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের তথ্যমতে, এবার হাকিমপুর উপজেলায় ৩০ টাকা কেজি দরে ৬৪৪ টন বোরো ধান ও ৪৪ টাকা কেজি দরে ৩৬৭ টন সেদ্ধ চাল সংগ্রহ করা হবে। আর জেলায় চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৩৫ হাজার ৫৪৬ টন ও ধান কেনা হবে ১৪ হাজার টন। তবে ধানের দাম বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন বর্গাচাষি কৃষকরা।
হাকিমপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মোছা: আরজেনা বেগম বলেন, উপজেলায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে। এখন পর্যন্ত উপজেলায় ৮০ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সার্বক্ষনিক পাকা ধান দ্রুত কাটার জন্য কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। সেই সাথে সম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার আগেই যেসব জমির ধান আশি ভাগ পেকে গেছে সেই সব জমির ধান তাড়াতাড়ি কাটা'র পরামর্শ দিচ্ছি। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন ইউনিয়নে সমন্বিত খামার ব্যবস্থাপনায় কৃষি যান্ত্রিককীরণ প্রকল্পের আওতায় ৫০ ভাগ ভর্তূকি দিয়ে দেওয়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনে ধান কাটা হচ্ছে। আশা করছি, শ্রমিক সংকট হবে না। এই বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ইতোমধ্যে ছাড়িয়ে গেছে।