দীর্ঘ ৭৫ বছর স্থানীয়দের দখলে থাকার পর অবশেষে দখলমুক্ত হলো হরিপুর জমিদার বাড়ির মূল অংশ। গত মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দখলমুক্ত করতে কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। তবে এখনো দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়নি জমিদার হরিপদ রায় চৌধুরীর স্ত্রীর স্নান করার পুকুরটি। দখলমুক্ত করার পুরো কাজটি তদারকি করেন নাসিরনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: ফখরুল ইসলাম।
নাসিরনগর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জমিদার বাড়িটিতে ৫২টি পরিবার অবৈধ দখল নিয়ে বসবাস করত। বাড়িটি দখল মুক্ত করতে বেশ কয়েক বার তাদের নোটিশ দেওয়া হয়। তারা দখল ছাড়তে রাজি হয়নি। পরবর্তীতে জেলা প্রশাসনের সাথে পরামর্শ করে ৫২টি পরিবাকে মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এরইমধ্যে ৪১টি পরিবারকে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয়ণ প্রকল্পে পূর্ণবাসন করা হয়েছে। ১১টি হিন্দু পুরোহিত পরিবার অন্যত্র জায়গা জমি ক্রয় করে বসবাস শুরু করেছেন। তবে তাদের আশ্রয়ণে ঘর দিতে চাইলেও তারা নিতে চায়নি।
বাড়িটি প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে যাওয়ার পর ২০১৭ সালে প্রায় ১১ লাখ টাকা ও ২০১৯ সালে ২৭ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই ধাপে সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বাড়িটির মূল অংশ দখলদারদের দখলে থাকায় সে কার্যক্রম থমকে যায়। বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের নিরাপত্তাকর্মী মো. রবিউল ইসলাম দাবি করে বলেন, বাড়িটির মূল অংশ দখলমুক্ত হলেও এখনো দখলদারদের কবলে রয়ে গেছে জমিদারের স্ত্রীর স্নান করার পুকুরটি। ওই পুকুরের সিঁড়ির আশপাশে গোখড়া সাপের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে গেলে দখলদার নিবারন দাসের ছেলে শংকর দাস বাঁধা প্রদান করেন। একাধিকবার স্থানীয় ইউনিয়ন ভূমি উপসহকারী কর্মকর্তাকে নিয়ে দখল মুক্ত করতে গিয়েও কোন সুফল আসেনি।
রবিউল বলেন, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তিনজনকে এবং উপজেলা আনসরা ভিডিপি ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৬ জন সদস্যকে এখানে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বাড়ি দখলমুক্ত হওয়ার পর গোখড়া সাপের আতঙ্কে দিন কাটছে। বাড়িটির আঙিনা পরিস্কার করতে গেলেই চারদিকে বড় বড় গোখড়া সাপের দেখা মিলছে। এ পর্যন্ত ২০টি সাপকে তারা মেরেছেন। সাপের ভয়ে ভবনের বাহিরে যেতেও ভয় পাচ্ছেন তারা। পুকুর দখলে বিষয়ে জানতে চাইলে দখলদার সংকর দাস দাবি করে বলেন, এটা আমার পূর্বপুরুষরা জমিদারের কাছ থেকে কিনে মালিক হয়েছে।আমরা প্রতি বছর সরকারি খাজনা (কর) দিচ্ছি।
তবে হরিপুর ইউনিয়ন ভূমি উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. আকিব আরাবি জানান, অনেকেই দাবি করছে জমিদারের কাছ থেকে কিছু ভূমি ক্রয় করে তারা মালিক হয়েছেন। কিন্তু আমরা চুড়ান্তভাবে যাচাই-বাছাই না করে কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছি না। তবে যারা নিজেদের মালিক দাবি করছে তাদের কাছ থেকে সরকারি কর আদায় বন্ধ রেখেছি।
প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর (কুমিল্লা অঞ্চল) সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দখলে থাকা ভবনগুলো দখল মুক্ত করে সিলগালা করা হয়েছে। জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে সিলগালাকৃত জরাজীর্ণ ভবনগুলোতে প্রশাসন এর পক্ষ থেকে জনসাধারনকে অনুপ্রবেশ না করার জন্য সর্তক করণ নোটিশ সাঁটানো হয়। নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করায় বাড়িটির নিরাপত্তার স্বার্থে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে।
স্থানীয়রা জানান, প্রায় ১৭৫ বছর পূর্বে জমিদার গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরী ও কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী বাড়িটি নিমার্ণ করেন। বৃটিশ আমলে নির্মিত বাড়িটির নিমার্ণ শৈলী বড়ই মনোরম। ১৩৪৩ বাংলার ১২ চৈত্র (দোল পূর্নিমা) তারিখে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরীর মূত্যুর পর পর্যায়ক্রমে বাড়িটির উত্তরাধিকার হন হরিপদ রায় চৌধুরী ও শান্তি রায় চৌধুরী। তাদের কাছ থেকে বাড়ির মালিকানা ও জমিদারি আসে উপেন্দ্র রায় চৌধুরী ও হরেন্দ্র রায় চৌধুরী। কালক্রমে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্ত হওযার পর জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হলে তারা বাড়িটি ফেলে কলকাতায় চলে যায়। জমিদাররা বাড়িটি ফেরে যাওয়ার সময় পুরোহিতদের রেখে যায়। এ বাড়িটিকে কেউ বলে রাজবাড়ি, বড়বাড়ি আবার কেউ বলে জমিদার বাড়ি। বর্তমানে এটা অর্পিত সম্পত্তি। প্রয়াত নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের ‘ঘেটুপুত্র কমলা”চল”িত্রের কয়েকটি চিত্র এখানে শুটিং হয়েছে। নাসিরনগর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে অবস্থিত এই বড়বাড়িটি।নাসিরনগর থেকে মাধবপুর যাওয়ার পথে উপজেলার শেষ সীমান্তে হরিপুর গ্রামের রাস্তার পশ্চিম পাশে তিতাস নদীর পাড়ে চোখে পড়ার মত দুই গম্বুজের তিনতলা সুবিশাল বাড়িটি। বাড়িটির পূর্ব পাশে নাসিরনগর-মাধবপুর সড়ক। বাকি দিকে তিতাস নদীর ফাঁকা জায়গা। বাড়ির বাইরে থেকে কিছুই বোঝার উপায় নেই। অনেক বড় বারান্দা ডিঙিয়ে মূল বাড়ি। কারুকাজ খচিত দেয়াল,স্তম্ভ ও কার্নিশ। কিন্তু খুব কাছে গেলে বোঝা যায়,এ বাড়ির জীর্ণ ও ভঙ্গদশা। জনশ্রুতি আছে, মেঘনা তথা তিতাসের পূর্বপ্রান্তে এত বড় বাড়ি আর কোথাও নেই। প্রায় ৪৮০ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত তিনতলা জমিদার বাড়িটিতে প্রায় ৬০টি কক্ষ,রং মহল,দরবার হল,ধানের গোলা,গোয়ালঘর, রান্নার ঘর,নাচ ঘর, মল পুকুর,খেলার মাঠ,মন্দির ও সীমানা প্রাচীর রয়েছে। বিশাল আয়তনের বাড়িটির পুরো ভবনের কোথাও কোন রডের গাঁথুনি নেই। লাল ইট সুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরি ভবনের দুপাশে দুটি সুউচ্চ গম্বুজ সগর্বে মাথা তুলে দাড়িঁয়ে ঘোষনা করছে, জমিদার বংশের ঐতিহ্যের কথা। দু’তলায় উঠার ৬ দিকে ৬টি সিড়িঁ ও তিন তলায় উঠার ২ দিকে ২টি সিঁিড় রয়েছে। বাড়তি পশ্চিম-উত্তর কোণে ৬টি বেড রুম এবং মল পুকুরের পূর্বপাড়ে ৪টি ও পশ্চিম পাড়ে ৪টি বেড রুম রয়েছে। বাড়ির পশ্চিম দিকে তিতাস নদীর পাড়ে পাকা ঘাটলার উত্তর দিকে কৃষ্ণ প্রসাদ রায় চৌধুরী ও দক্ষিণ দিকে গৌরী প্রসাদ রায় চৌধুরীর সমাধি মঠ রয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে ওই পরিবারের সদস্যরা পাড়ি জমান ভারতের কলকাতায়। সেই থেকে প্রায় ৭৫ বছর ধরে বাড়িটি ছিল বেদখলে।
এবিষয়ে আঞ্চলিক পরিচালক (কুমিল্লা অঞ্চল) এ কে এম সাইফুর রহমান জানান,জেলা প্রশাসক ও উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগের ফলে জমিদার বাড়িটি দখল মুক্ত হয়েছে। আমাদের অনেক পরিকল্পনা রয়েছে এই বাড়িটি নিয়ে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে দ্রুত সময়ের মধ্যে সংস্কার কাজ শুরু করব।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. ফখরুল ইসলাম জানান,আমরা পুরনো এই ঐতিহ্যকে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। এতদিন দখলের কারণে সংস্কার কাজ করা যায়নি। কিন্তু জেলা প্রশাসক মহোদয়ের পরামর্শক্রমে দখলদারদের মুজিববর্ষের প্রধানমন্ত্রীর উপহার আশ্রয়ণের ঘরে তাদের পুর্নবাসন করা হয়েছে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে এ্ বাড়িটিকে দর্শনার্থীদের উপযোগী করে সংস্কার কাজ করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।