ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, আমরা দেখেছি, আগে সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যেতো আমাদের প্রিয় এই শহর ঢাকা। জলনিমগ্ন হয়ে পড়তো পুরো নগরের প্রায় ৭০ ভাগ এলাকা। কিন্তু সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকা শহর এখন আর ডুবে যায় না। মঙ্গলবার ডিএসসিসি নগর ভবনের মেয়র হানিফ মিলনায়তনে ‘উন্নত ঢাকার উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় তিন বছর’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে দায়িত্বভার নেওয়ার ৩ বছর পূর্তি উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে নিজস্ব অর্থায়নে ২২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গত তিন বছরে ১৩৬টি স্থানে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন করা হয়েছে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকা শহর এখন আর ডুবে যায় না। তিনি বলেন, ধানমন্ডি-২৭, পলাশী মোড়, আজিমপুর মোড়, শান্তিনগর, রাজারবাগ, সচিবালয়, মতিঝিল এলাকা বিশেষত নটরডেম কলেজের সামনের অংশ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের সামনের রাস্তা, সূত্রাপুর শিল্পাঞ্চল এখন আর পানিতে ডুবে যায় না। দায়িত্ব নেওয়ার পর জলাবদ্ধতা নিরসনে আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। মেয়র বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসনে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কার্যক্রমের অংশ হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, খাল, নর্দমা, বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য ও পলি অপসারণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম আধুনিকায়ন, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধার এবং খাল সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টির মতো কার্যক্রমের সুফল নগরবাসী ইতোমধ্যে পেতে শুরু করেছেন। তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দীর্ঘ ৩৪ বছর পর ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর শাখা প্রশাখাসহ ১১টি অচল খাল, বর্জ্যে জমাটবদ্ধ পাঁচটি বক্স কালভার্ট ও প্রায় ২০০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে নলিকা নর্দমার মালিকানা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। মেয়র বলেন, দায়িত্ব নেওয়ার পরের দিন থেকে এসব খাল, বক্স কালভার্ট ও নর্দমা থেকে বর্জ্য অপসারণ, সীমানা নির্ধারণ ও দখলমুক্তির কার্যক্রম শুরু করি। এসব খাল, কালভার্ট ও নর্দমা থেকে ২০২১ সালে ৮ লাখ ২২ হাজার মেট্রিক টন, ২০২২ সালে ৪ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন এবং চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১ লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য ও পলি অপসারণ করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন শ্যামপুর, মান্ডা, জিরানী ও কালুনগর এই চার খালের বর্জ্য ও পলি অপসারণ এবং খাল সংস্কার করে নান্দনিক পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৮৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া এই চারটি খালের নকশা, অঙ্কন ও জরিপ কাজ চলমান রয়েছে। একইসঙ্গে এসব খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ ও ভূমি উন্নয়নের লক্ষ্যে দরপত্র কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। তিনি বলেন, ডিএসসিসি দায়িত্ব নেওয়ার পর এ অঞ্চলে দুর্নীতি কমেছে। অনিয়ম-অপরাধের কারণে চাকরিচ্যুত হয়েছেন শতাধিক। উদ্ধার করা হয়েছে ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার সম্পত্তি। প্রশাসনিক সংস্কারের আওতায় এসব প্রক্রিয়া চলমানও রয়েছে। তাপসের বক্তব্য অনুসারে ডিএসসিসিতে দুর্নীতি কমেছে। বেড়েছে রাজস্ব আয়। দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই তিনি অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে ‘শূন্য সহনশীলতা’ বা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি বাস্তবায়ন করে চলছেন। মেয়রে বলেন, শূন্য সহনশীলতা আছে বলেই গত তিন বছরে দুর্নীতি, অনিয়মসহ নানা অপরাধে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজনীয় জনবলে ঘাটতির প্রকটতা কমাতে ভারি গাড়ির ১০৯ জন চালকসহ পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ফলে, নাগরিক সেবা ও করপোরেশনের নৈমিত্তিক কাজে যেমন গতি এসেছে, তেমনি বৃদ্ধি পেয়েছে তদারকি ও উন্নয়ন কার্যক্রম বাস্তবায়নের হার। বিধায় দুর্নীতি কমেছে ও রাজস্ব আয় বেড়েছে। মেয়র নির্বাচনের প্রাক্কালে আমি ঢাকাবাসীর ওপর কোনো করের বোঝা না চাপিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেছিলাম। সেই প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিগত ৩ বছরে আমরা কোনো খাতে কোনো কর বৃদ্ধি করিনি। বরং এ সময়ে ২৫টি নতুন খাত সৃষ্টি করা হয়েছে এবং চৌদ্দটি নতুন খাত থেকে আমরা রাজস্ব আদায় শুরু করেছি। ফলে করোনাভাইরাস মহামারির মতো বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও রাজস্ব আদায়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ইতিহাস সৃষ্টি করে চলেছে, যা অদ্যবদি অগ্রসরমান। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কর্পোরেশনের রাজস্ব আদায় ছিল মাত্র ৫১৩ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা, যা ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যথাক্রমে ৭০৩ দশমিক ৩১ কোটি এবং ৮৭৯ দশমিক ৬৫ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। তাপস বলেন, আমরা যেমন দীর্ঘদিন ধরে অনিয়মের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হওয়া ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট, সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটসহ অনেকগুলো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করেছি, তেমনি দখলমুক্ত করা হয়েছে বুড়িগঙ্গা আদি চ্যানেল ঘিরে গড়ে ওঠা কয়েক ডজন অবৈধ বহুতল ভবন ও স্থাপনা। দখলমুক্তির ধারাবাহিকতায় আমরা দীর্ঘ ৮০ বছর পর সূত্রাপুরের মাইশা খাল, তিন দশক পর রায় সাহেব বাজার মোড়, দুই যুগ পর লক্ষ্মীবাজারে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পার্কিংয়ের জায়গা, চল্লিশ বছর পর ধলপুর ক্লিনার কলোনি থেকে অবৈধ দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়েছি। ফলে, বিগত ৩ বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন শতাধিক উচ্ছেদ অভিযানের মাধ্যমে ৩৪ একরের বেশি জমি উদ্ধার করেছে, যার আনুমানিক বাজার মূল্য ৩ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বেশি। তিনি আরও বলেন, আমরা আগেকার প্রায় সব বকেয়াসহ প্রাত্যহিক পাওনা পরিশোধ করেছি। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন নিজস্ব অর্থায়নে জলাবদ্ধতা নিরসনে অবকাঠামো নির্মাণ ও উন্নয়ন, খাল ও নর্দমা হতে বর্জ্য অপসারণ, কর্পোরেশনের প্রায় সব গাড়ির নিবন্ধন, দীর্ঘ ৫০ বছরের ভূমি উন্নয়ন করসহ অন্যান্য পুঞ্জীভূত পাওনাদিও পরিশোধ করা হয়েছে। ডিএনসিসির এ পিতা বলেন, সামষ্টিকভাবে বলতে পারি, দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অটল, অদম্য ও অনমনীয় কর্মোদ্যোগের ফলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে সুশাসন নিশ্চিত হয়েছে। পাশাপাশি ঢাকাবাসীর আস্থা বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির মাধ্যমে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আজ একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ও মর্যাদাপূর্ণ সংস্থা হিসেবে যেমন নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে, তেমনি তাসের ঘরের মতেই ভেঙে পড়তে শুরু করেছে দীর্ঘদিনের দখলদারিত্বের পোক্ত সাম্রাজ্য। আপনাদের সবার সহযোগিতায়, আমরা দখলদারিত্ব সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়েই এগিয়ে চলব। সংবাদ সম্মেলনে গত তিন বছরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সার্বিক উন্নয়ন চিত্র তুলে ধরেন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। এ সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সব বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ কাউন্সিলররা উপস্থিত ছিলেন।