পঞ্চগড়ে চা কারখানা মালিকদের একতরফা সিন্ডিকেট ৩০ থেকে ৫০ % হারে কর্তন করে সবুজ কাঁচা পাতা কেনায় ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সেট বাগান উপড়ে ফেলছে চাষীরা।
জানা যায় ২০০০ সালের দিকে তেঁতুলিয়া টি কোম্পানি লিমিটেড ও কাজী এ- কাজী পঞ্চগড়ে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু করে। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে উত্তরাঞ্চলের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ক্ষুদ্র পর্যায়ে ২০২১ সালের মধ্যে ৫০০ হেক্টর জমি নতুন করে চা চাষের আওতায় আনতে সেপ্টেম্বর ’১৫ থেকে জুন ’২১ মেয়াদে ৭৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘ দেশের উত্তরাঞ্চলে ছোট ছোট চা চাষের সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে চা বোর্ড। উত্তরবঙ্গের পাঁচ জেলায় ৯টি নিবন্ধিত চা বাগান, ২১টি অনিবন্ধিত চা বাগান এবং ৮ হাজার ৬৭টি ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান (নিবন্ধিত ১৭৪৫) মোট ১১ হাজার ৪৩৩ দশমিক ৯৪ একর সমতল জমিতে চা চাষ হয়েছে। পঞ্চগড়ে ২১ বছরে চায়ের উৎপাদন ছাড়িয়ে গেছে ১৬১ বছর আগে শুরু হওয়া চট্টগ্রামকে। বর্তমানে যার পরিমাণ ১ কোটি ৪৫ লাখ কেজি।
ক্ষুদ্র চা বাগানের মালিকরা জানান, বর্তমানে বাজারে সার ও কীট নাশকের দাম এক লাফে দেড় থেকে দ্বিগুন দাম বাড়লে চা পাতার দাম বাড়েনি। কখনো কারখানায় কাঁচা সবুজ চা পাতার নিম্নদাম নির্ধারণ এবং ৩০ থেকে ৫০% হারে কারখানায় কর্তন। বছরে প্রতি মৌসূমে ৬-৭টি রাউন্ডে বাগানের সবুজ কাঁচা চা পাতা তুলে বিক্রির সময় প্রতিটি রাউন্ডে বাগান মালিকদের নানান বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। ফলে বাগানের পাতা বিক্রি ও কারখানায় সরবরাহ দিয়ে চাষীদের হাতে কোন টাকা থাকে না। প্রতি বছর ভরা চা উৎপাদন মৌসূমে কারখানা মালিকদের এমন অজুহাত বিট্রিশ কোম্পানীর নীল চাষীদের হার মানায়। কারণ বিট্রিশ কোম্পানি কর্তৃপক্ষ সেই সময়ে পূর্ব বাংলার কৃষকেরদ নীলচাষের জন্য নানাভাবে সাহায্য সহযোগিতা করত। পরবর্তীতে ফসল বিক্রির সময় তাদের কাছে নানা অনুনয়-বিনয় করে লকসান দিয়ে নীল বিক্রি করতে হতো। যে কারণে পুর্ব বাংলায় তৎকালীন নীল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছিল। বাংলাদেশ চা বোর্ড পঞ্চগড় জেলা অফিসের কর্মকর্তা, কারখানার মালিক, রাজনৈতি নেতা ও জনপ্রতিনিধি, পঞ্চগড় পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক পঞ্চগড় যৌথ সভায় একাধিকবার সবুজ কাঁচা পাতার দাম সর্বনিম্ন ২০ টাকা এবং ডাস্ট কর্তন ৫-১০% হার নির্ধারণ করেন।
ক্ষুদ্র চা চাষীদের অভিযোগ, চলতি মৌসূমে আকাশে বৃষ্টিপাত ও সকালে কোন শিশির কণা নেই। গভীর নলকূপ আর শ্যালো মেশিন দিয়ে বাগানে পানি সেচ দিয়ে তালগোল খেতে হচ্ছে। এ মৌসূমে লাগার খরার কারণে বাগানের চা গাছ পুড়ে মরে যাচ্ছে। বাগানে লাল মাকড় সহ নানা রোগ বালায়ের প্রাদূর্ভাব বেড়েছে। ক্ষেত্রে রোগ বালাই দমনের সার-কীটনাশকের দাম কয়েকগুন বেড়ে গেছে। বর্তমানে চলতি বছরে বাগানে সবুজ চা পাতা তোলার প্রথম রাউন্ড মৌসূম শুরু হয়েছে। চা বাগান থেকে খসখসে শুকনা সবুজ কাঁচা পাতা তোলে কারখানায় সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু চা কারখানাগুলো প্রতিকেজি সবুজ কাঁচা পাতা প্রায় ১৩-১৬ টাকা দরে কেনার পাশাপাশি ৩০-৫০% হারে কর্তৃনপূর্বক চাষীদের মূল্য পরিশোধ করেন। কোন কোন কারখানার মালিক চাষীদের পাতা ক্রয়ের পর টাকা প্রদানের লম্বা সময় বেঁধে দেন। এক্ষেত্রে কোন চাষী প্রতিবাদ করলে পরবর্তীতে তার বাগানের পাতা মিলে নিতে চান বলেও জানান। ফলে চা চাষীরা অর্থনৈতিকভাবে চরম ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।
পঞ্চগড়ে চা পাতা ন্যায্যমূল্যের দাবিতে চাষীরা বিগত কয়েক বছর ধরে মানববন্ধন ও মহাসড়কে কাঁচা ছিটিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ করে আসছে। কিন্তু দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে সবুজ কাঁচা পাতার মূল্য নির্ধারণ নিয়ে আন্দোলন প্রতিবাদ করার পরও ন্যায্য মূল্য না পেয়ে অনেক ক্ষুদ্র চা চাষী বর্তমানে সেট বাগান (৫-১০ বছরের পুরনো বাগা) উপড়ে ফেলছে। অনেক চা চাষী বাগানের পরিচর্চাও করছে না। ফলে চা বাগান আর চাষীদের অর্থনৈতিক অবস্থা দিনদিন নাজুক হয়ে পড়ছে। চাষীদের দাবী, বর্তমানে সার, কীটনাশক ও শ্রমিক মূজুরি বাড়ায় বাগানে প্রতি কেজি কাঁচা চা পাতার উৎপাদন ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৫-১৬ টাকা খরচ হয়। কারখানা মালিকগণ প্রতিকেজি চা পাতা কমপক্ষে ২০-২৫ টাকা হারে ক্রয় করলে তাদের অর্থনৈতিক লোকসান কিছুটা কমবে।
এদিকে আগামী জুন মাসে পঞ্চগড়ে দেশের তৃতীয় চা নিলাম মার্কেট উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। কিন্তু বাগান মালিকেরা সেট বাগান উপরে ফেলায় সমতলের সবুজ অর্থনীতি হুমকীর মুখে পড়ে। পঞ্চগড়ের চা শিল্পের এমন অবস্থা চলতে থাকলে কোন একসময় কারখানার মালিকেরা কাঁচা মালের অভাবে উৎপাদন বন্ধ করে দিবে। ফলে বীমা-ব্যাংক থেকে গ্রহণকৃত ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে সরকারের কাছে দেউলিয়া হয়ে বসবে। অপরদিকে সরকার পঞ্চগড়ের চা শিল্প থেকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাবে। তাই পঞ্চগড় জেলার সচেতন মহলের দাবী, বিপুল সম্ভাবনাময় সবুজ অর্থনীতি শিল্পকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার জন্য কারখানা মালিকদের চাষীদের সবুজ কাঁচা পাতার ন্যায্য মূল্য প্রদানের জোর দাবী জানিয়েছেন।
এবিষয়ে মুঠোফোনে জানতে চাইলে পঞ্চগড় আঞ্চলিক চা বোর্ডের উন্নয়ন কর্মকর্তা মোঃ আমির হোসাইন বলেন, দেশের উত্তরাঞ্চলে রংপুর বিভাগের পাঁচ জেলায় বিপুল সম্ভাবনাময় গ্রীণ অর্থনীতি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এজন্য চাষীদের ভাল মানের পাতা কারখানায় সরবরাহ করবে হবে এবং কারখানার মালিকদেরও কাঁচা পাতার ন্যায্য মূল্য দিতে হবে। চা বোর্ডের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে নানাভাবে প্রচার-প্রচারনা জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে মিটিং করা হচ্ছে।
তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সোহাগ চন্দ্র সাহা বলেন, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ক্ষুদ্র চা চাষীদের পাতার ন্যায্যমূল প্রদানের জন্য কারখানা মালিকদের সংগে একাধিকবার জেলা প্রশাসনের সমন্বয়ে মিটিং করে পাতার দর ১৮ টাকা এবং ডাস্ট ৫-১০% নির্ধারণ করা হয়েছে। যদি এই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করেন তবে কারখানাগুলোতে প্রশাসনের নজরদারী করা হবে। সেই সংগে চা শিল্পকে টিকিয়ে রাখার জন্য চা চাষী এবং কারখানার মালিকদের নিয়ে পুনরায় যৌথ আলোচনা করার চেষ্টা চলছে।