‘জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব বাড়ছে না, বাড়ছে সরকারি ঋণ’। দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের সরকারি রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ও কর-জিডিপির অনুপাত এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন ছিল, কিন্তু বর্তমান ২০১৯ সালের পর এই অনুপাত আরও কমছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে পর্যায়ে অবস্থান করছে, সেখানে রাজস্বের প্রধান উৎস হওয়ার কথা আয়কর। কিন্তু বর্তমানে আয়কর রাজস্ব আহরণের তৃতীয় সর্বোচ্চ খাত হিসেবেই রয়ে গেছে। এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সরকারি ঋণের প্রবৃদ্ধি অস্বাভাবিক রকমের বেশি হয়ে গেছে। ফলে অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক উভয় ধরনের ঋণের কিস্তি ও সুদ পরিশোধ অতি দ্রুত অর্থনীতির জন্য বোঝা হিসেবে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে যাবে এবং এমনকি অর্থবছরের শেষে এই খাতে প্রকৃত ব্যয় আরও বাড়তে পারে। যেমন আগামী বছরেই সুদ পরিশোধ খাতে সরকারি ব্যয়-বরাদ্দ এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ বর্তমান বাজেটের আনুমানিক দুই বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে আনুষ্ঠানিক পথে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ আগের বছরের এপ্রিল মাসের চেয়ে ১৬ শতাংশ কমে গেছে, যাকে সরকারের জন্য ‘অশনিসংকেত’ মনে হচ্ছে। উপরন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেশের রপ্তানি আয়ও তেমন বাড়ছে না। অন্যদিকে, জিডিপির অনুপাত হিসাবে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ এখনো বিপজ্জনক পর্যায়ে উন্নীত না হলেও বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে সরকারের খামখেয়ালি বিনিয়োগের স্পৃহা এখনো অব্যাহত থাকায় অতি দ্রুত বৈদেশিক ঋণ বেড়ে চলেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে দেশের বেসরকারি খাতের ব্যবসায়ীদের নানা সূত্র থেকে বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের অদম্য আগ্রহ, যার ফলে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণও বেড়ে ২৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এসব ঋণের গ্যারান্টার হতে হয় বাংলাদেশ সরকারকে। এই একটি কারণে গত এক বছরে দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের ফাইন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টে বড়সড় ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, যার ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো থামানো যাবে না।
বর্তমান ৭ দশমিক ৭ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একেবারেই বেমানান। দেশে বর্তমানে প্রায় দুই লাখ মানুষের এক কোটি টাকার বেশি ব্যাংক আমানত রয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের আয়করের আওতায় নিয়ে আসার প্রক্রিয়া এখনি শুরু করা উচিত। প্রয়োজনে আয়কর বিভাগে জনবল বাড়িয়ে এবং নতুন ব্যক্তি থেকে আয়কর আদায় করতে পারলে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিক প্রণোদনা প্রদানের ব্যবস্থা চালু করে আয়কর সংগ্রহে গতিশীলতা সৃষ্টি করা হোক। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত অন্তত ২০-২২ শতাংশে উন্নীত করতে না পারলে সঙ্কটের কোনো সমাধান হবে না।’ সেক্ষেত্রেও বিদেশী ঋণ পরিশোধের জন্য রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ওপর নির্ভর করতে হবে। আবার, এরইমধ্যে সরকার মেগা প্রকল্পে আরো বেশি বিদেশী ঋণ নেয়ার জন্য উদ্যোগী হয়েছে। এ অবস্থায় রাজস্ব আয় বাড়িয়েও যথাসময়ে বিদেশী ঋণ পরিশোধ দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। এ সংকট থেকে উত্তরণের জন্য আমাদের কর ব্যবস্থাপনা ও কর কাঠামোতে ব্যাপক সংস্কার আনতে হবে। কর আহরণের পরিধি সম্প্রসারণ করতে হবে। অনিয়ম, দুর্নীতি ও অদক্ষতা দূর করতে হবে। একথা সত্য, কর কাঠামোর সংস্কার রাতারাতি করা সম্ভব নয়। আমাদের নিজেদের স্বার্থেই এটি বাড়ানো দরকার। কেননা, রাজস্ব বাড়লে বিদেশি ঋণ পাওয়া আরও সহজ হবে।