তেঁতুলিয়ায় বিভিন্ন পাথর সাইটে পুরুষের পাশাপাশি কাজ করেও নারী শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরী পাচ্ছে না। তেঁতুলিয়া উপজেলায় পাথর শ্রমিকের সংখ্যা কত এর সঠিক পরিসংখ্যানের সরকারি কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। ২০০৮ সালের ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম জরিপ ইএসডিও’র তথ্য মতে, উপজেলার ২ হাজার ৫শত ৫৩টি পরিবারের মধ্যে ৪ হাজার ১শত ১৭জন শিশু শ্রমিক রয়েছে। এই তথ্যেও সঠিক পাথর শ্রমিককের সংখ্যা উঠে আসেনি। পাথর ব্যবসায়ী ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সংগে কথা বলে জানা যায় তেঁতুলিয়ায় পাথর শিল্পে জড়িত প্রায় লক্ষাধিক মানুষ। এ ছাড়া পাশবর্তী নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও দিনাজপুর, লালমনিরহাট এলাকা থেকে আসা সংখ্যালঘু ও আধিবাসী নারী-পুরুষ শ্রমিকের সংখ্যাও প্রায় ২০ হাজার ছড়িয়ে যাবে। অন্য জেলা থেকে আসা এসব পাথর শ্রমিক বাংলাবান্ধা, সিপাইপাড়া, তিরনইহাট, শালবাহান, বালাবাড়ী, মাঝিপাড়া, ভজনপুর ও বুড়াবুড়ি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে কাজ করেন। নারী শ্রমিকরা প্রতিদিন কাকডাকা ভোরে ঘুম থেকে উঠে সংসারের যাবতীয় কাজ গুছিয়ে ঘর ছেড়ে পুরুষের সংগে পাথর সাইটে কাজের সন্ধানে বেড়িয়ে যান। ১০ জন থেকে ১৫ জনের দলে বিভক্ত হয়ে নারী শ্রমিকরা সংগে ৪-৫ জন পুরুষ শ্রমিককে নিয়ে কাজ করেন। সারাদিন পাথর ক্র্যশিং মেশিনে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে অনেকে সংসারের হাল ধরে নিজের ভাগ্যকে ফিরায়েছেন আর্থিক স্বচ্ছলতায়। কিন্তু সমান পরিশ্রম করলেও পুরুষের তুলনায় নারী শ্রমিকরা এখনো ন্যায্য মজুরী পেতে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
আগে যারা কৃষি কাজে শ্রম বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করত। বর্তমানে তারা পাথর শিল্পের নেটিং, সটিং, লোডিং ও আনলোডিং কাজের সাথে সম্পৃক্ত। পাথর শিল্পে শুধু পরিবারের কর্তা পুরুষের কিংবা নারীরা জড়িত নয় বরং তাদের কিশোর ছেলে-মেয়েরাও জড়িত হয়ে পড়ছে ঝুঁকিপুর্ণ শিশু শ্রমে। দীর্ঘ প্রায় দু’যুগ আগে তেঁতুলিয়ার বিপুল সংখ্যক শ্রমিক কৃষি কাজের ফাঁকে হিমালয় থেকে প্রবাহিত মহানন্দা নদীর খরস্রোতে সাঁতার কেটে কলার ভেলা নিয়ে নুড়ি পাথর সংগ্রহ জীবন-জীবিকা নির্বাহ করেন।
সংখ্যালুঘু নারী পাথর শ্রমিক অর্পিতা রাণীর সংগে আলাপ চারিতায় জানা যায়-প্রত্যেহ ভোরে তার ঘুম থেকে উঠে সংসার সব কাজকর্ম গুছিয়ে নিয়ে সকাল ৮ টার মধ্যে মহাজনের পাথর সাইটে পৌছাতে হয়। তাড়াহুড়ো করে নিজের ও দুই সন্তানের জন্য রান্না করতে হয়। সন্তানদের কোনদিন খাইয়ে কোন দিন না খাইয়ে তাকে বেরিয়ে পড়েন। কাজে দেরিতে পৌছালে মহাজনের গালিও শুনতে হয়। সারাদিন সন্তান খেলো কি খেলোনা খোঁজ নিতে পারে না।
আবেগ আপ্লুত ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের জহুরা চোখের জল ছল ছল করছে। সে আঞ্চলিক ভাষায় জানান তার দুখের কথা- কয়েক বছর আগে স্বামী সংসার ছেড়ে ঢাকাত গিয়ে আরেকটা বিহা করিছে। এইঠে মুই’ পাথর ভাঙ্গা মেসিনত কাজ করে দুই ছুয়াক লেখাপড়া ও সংসার করেছু। এ সংসারের কোন খবর নেন না। এই নারী শ্রমিকের আক্ষেপ পুরুষ শ্রমিকদের দেরী হলেও মহাজন কাজে নেন। কিন্তু নারী শ্রমিকদের দেরী হলে মহাজনরা কাজে নেয় না। পুরুষের সংগে সমান সমান কাজ করছু কিন্তু হামার মুজুরী কম দেন এক’শ টাকা।
৯০ দশকের আগে এই উপজেলার নারীরা ঘর থেকে বের হতো না। কিন্তু নিজেদের প্রয়োজনে ও অভাবের তাড়নায় ক্রমেই প্রায় ৩০ হাজার নারী শ্রমিক পাথর শিল্প সহ অন্যান্য শিল্পের সংগে জড়িয়ে পড়ে। দেশের সর্ব উত্তরের এ উপজেলার ভূ-গর্ভস্থ পাথর উত্তোলন-প্রক্রিয়াকরণ ছাড়াও সমতল ভূমিতে চা চাষ, চা পাতা সংগ্রহ, ভবন নির্মাণ ও কৃষি কাজে পুরুষের পাশাপাশি এদের অবদান অপরিসীম। পাথর ভাঙাসহ বিভিন্ন কাজ করে সংসারের হাল ধরেছে এসব নারী শ্রমিকরা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিনভর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে এসব নারীরা সমাজ ও দেশের অর্থনীতিতে ক্রমাগত অবদান রাখছে। কেবল নিজেদের প্রচেষ্টায় তাদের জীবন যাত্রার পথ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেলেও তেঁতুলিয়ার নারী শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সম-অধিকার নামক শব্দটি এখনও বাস্তবে প্রয়োগ হচ্ছে না। নারী শ্রমিকরা কর্মক্ষেত্রে আজও চরম ন্যায্য মজুরি বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। সমান কাজ করেও তাদের ভাগ্যে মিলেনা সমান মজুরি। পাথর ক্র্যশিং মেসিনে সারাদিন কাজ করে পুরুষ শ্রমিকরা চার’শ থেকে পাঁচ’শ টাকা মজুুির পেলেও নারী শ্রমিকরা পান আড়াই’শ টাকা থেকে তিন’শ টাকা। একই পরিমান কাজ করলেও তারা পুরুষ শ্রমিকদের অর্ধেক মজুরি পান। উপজেলার নারী শ্রমিকরা শুধু সম-অধিকার নয় কর্মক্ষেত্রে নিজেদের ন্যায্য মজুরি দাবি করেছেন।
তেঁতুলিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান (ডাবলু) বলেন-বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা নারীদের কর্মের মূল্যায়ন এবং নারীর জীবনমান উন্নয়নে আয়বদ্ধক নানামুখী প্রশিক্ষণ দিয়ে নারীদের সাবলম্বি করে তুলছে। পঞ্চগড় জেলার পাশবর্তী অনেক জেলা থেকে হাজার হাজার নারী-পুরুষ এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাথর শ্রমিকের কাজ করেন। যেসব পুরুষ শ্রমিক হাতুড়ি দিয়ে বড় পাথর ভাঙ্গে তাদের মঞ্জুরী কিছুটা বেশি। কিন্তু ক্রাসিং মেশিনে পুরুষ ও নারী পাথর শ্রমিকের মঞ্জুরী সমান। আমরা উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের নারী ও পুরুষ শ্রমিকের সমান মুজুরী দেয়ার ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা করে আসছি।