আন্দোলন বন্ধ করতে সরকার ভয়াবহ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তাঁর অভিযোগ, সরকার বিরোধী দলের সাড়ে ১৩শ মামলা নিয়ে মাঠে নেমেছে। তার অভিযোগ, আগামী নির্বাচনের আগে এই মামলাগুলো দ্রুত শেষ করে কীভাবে বিএনপি নেতাদের সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো যায়, তা ভাবছে সরকার, যাতে নির্বাচনে প্রতিপক্ষ ছাড়া খালি মাঠে গোল দেওয়া যায়। বুধবার দুপুরে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে ফখরুল এসব কথা বলেন। সরকার ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রকে বেআইনিভাবে ব্যবহার করছে অভিযোগ করে ফখরুল বলেন, সরকার রাষ্ট্রের সমস্ত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে আছে। অত্যন্ত ক্ষোভ ও বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, যে মামলা হাইকোর্ট খারিজ করে দিয়েছে, পুনরায় শুনানি করে সে মামলায় রাজনৈতিক নেতাদের সাজা দেওয়া হলো। মৃত্যু ঘনিয়ে আসার আগে যখন কোনো আশা থাকে না তখন কোনো কিছু আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা। সরকার হামলা-মামলা দিয়ে সে চেষ্টাই করছে। তিনি বলেন, একইভাবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ও তার স্ত্রী জোবায়দা রহমানের ২০০৭ সালের মামলাগুলো অতি দ্রুত চালু করা হয়েছে। আত্মপক্ষের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। প্রতিদিন সাক্ষী হাজির করা হচ্ছে। এ নিয়ে কোর্টে বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা কথা বলতে চাইলে তাদের ওপর সরকারি দলের আইনজীবীরা হামলা করেন এবং পুলিশ দিয়ে নির্যাতন চালান। প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে সরকার এমন নোংরা ষড়যন্ত্র করছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, একই ধরনের মামলায় বিচারক আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জেল হোসেন চৌধুরী মায়াকে খালাস দিয়েছেন, অথচ ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও তার স্ত্রীকে সাজা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সারাদেশে এ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়েছেন সাত শতাধিক নেতাকর্মী। গত ১২ দিনে নতুন মামলা হয়েছে ১৫২। আসামি সাড়ে পাঁচ হাজার। ভয়-ত্রাস সৃষ্টি করে তারা এক কায়দায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। কিন্তু মানুষ এবার তা সফল হতে দেবে না। ফখরুল বলেন, এই দানবীয় সরকারকে সরানোর যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা হামলা-মামলা দিয়ে দমানো যাবে না। আমাদের কর্মসূচিতে আগ বাড়িয়ে সমস্যা সৃষ্টি করে উল্টো আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হচ্ছে। কেরানীগঞ্জে আমাদের নিপুণ রায়কে মেরে আহত করা হলো, অথচ তাকেই মামলার এক নম্বর আসামি করা হয়েছে। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু, বরকত উল্লাহ বুলু, আবদুল আউয়াল মিন্টু, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের আহ্বায়ক আবদুস সালাম, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, ঢাকা মহানগর উত্তরের সদস্য সচিব আমিনুল হক প্রমুখ।
অন্যদিকে বুধবার জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে আয়োজিত ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) একাংশের দ্বি-বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আমরা অত্যন্ত সংকটময় একটি মুহূর্ত অতিক্রম করছি। এ সংকটময় মুহূর্তে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, যে যেখানে আছি, যে অবস্থায় আছি, সেখান থেকে আমাদের সোচ্চার হতে হবে। আমাদের কথা বলতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা, গণতন্ত্রের মূল কথাগুলো বলতে হবে। এটি আমাদের দায়িত্ব। বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, আজকে পুরো বিশ্ব এ কথাটি স্বীকার করে নিয়েছে, বাংলাদেশে স্বাধীন সাংবাদিকতার কোনো জায়গা নেই। এখন বাংলাদেশ পুরোপুরিভাবে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসকদের হাতে পড়ে গণতন্ত্রের যে মূল স্তম্ভ বাক স্বাধীনতা সেটি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে করে ফেলেছে। পুরো বিশ্বের যারা মুক্ত স্বাধীনতা, গণতন্ত্র বিশ্বাস করেন, তারা সবাই একবাক্যে বলছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র নেই, মুক্ত সাংবাদিকতা নেই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নেই, ভিন্নমত সহ্য করার মতো এখনকার শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা নেই। তারা তাদের ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার জন্য, একদলীয় শাসনকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষে অত্যন্ত তীব্রভাবে, বল প্রয়োগ করে মানুষের ভিন্নমত পোষণ করা অধিকার, ভোটের অধিকার, বেঁচে থাকার অধিকারকে ক্ষুণœ করছে। তিনি বলেন, প্রতিবাদ না করলে, প্রতিবাদে সোচ্চার না হলে এবং রুখে না দাঁড়ালে কখনো দাবি আদায় করা যায় না। আজকে বাংলাদেশের সামনে একটি সত্য এসে উপস্থিত হয়েছে। এখানে নির্বাচন কখনোই সুষ্ঠু, অবাধ, গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। এখানের মানুষ কখনও নিজের ইচ্ছায় নিজের মত প্রকাশ করতে পারবে না ভোট প্রদানের মাধ্যমে যদি আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আজকে প্রত্যেকেই এ কথায় এসে দাঁড়িয়েছে, বর্তমান সরকার থাকলে নির্বাচন কখনোই গ্রহণযোগ্য, অবাধ ও সুষ্ঠু হতে পারে না। আওয়ামী লীগ, সরকার সব সময় জনগণকে মিথ্যা কথা বলে, প্রতারণা করে, ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে চায় অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, তাদেরকে পরিষ্কার করে বলে দিতে হবে, এনাফ ইজ এনাফ। মানুষকে অনেক কথাবার্তা বলে বোকা বানিয়েছ। এতদিন বলে এসেছেন, উন্নয়ন হবে৷ উন্নয়ন কি আমাদের চোখে পড়ে না। আমরা কি চোখে ঠুলি দিয়েছি। সেই উন্নয়ন এখন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? আজকে অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলো বলছে, এখন যে সময় যাচ্ছে, দেশের অর্থনীতিতে এত খারাপ সময় আর আসেনি। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার তৈরি করতে হবে। যেখানে জবাবদিহিতা থাকবে, দায় থাকবে। আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে সে সংগ্রামে জয়ী হতে চাই। তিনি আরও বলেন, ইদানীং পত্রিকায় খবর এসেছে, আমেরিকা থেকে নাকি প্রচুর রেমিট্যান্স এসেছে। কিন্তু আমেরিকায় যারা যায়, তারা দেশে এসে কোনো বিনিয়োগ বা লগ্নি করে না। তারা সেখানেই থাকে, প্রয়োজনে এখানকার বাড়িঘর বিক্রি করে দেয়। আমেরিকা থেকে রেমিট্যান্স আসার মূল কারণ হচ্ছে, যারা কোটি কোটি টাকা পাঁচার করে সে দেশের বিভিন্ন স্থানে রেখেছিল, দেখা যাচ্ছে সেটি এখন নিরাপদ নয়। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা খোঁজখবর নেওয়া শুরু করায় সেসব পাঁচার করা টাকা দেশে পাঠানো শুরু করেছে। সরকার আবার ঘোষণা দিয়েছে, পাঁচার করা টাকা ফেরত আনলে নাকি আড়াই পার্সেন্ট ইনসেন্টিভ দেওয়া হবে। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসে আমাদের আজ এসব দেখা লাগছে। তিনি বলেন, দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে এখনো গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। অনেক প্রতিথযশা রাজনীতিবিদরা শহীদ হয়ে গেছেন। যেসব কর্মীরা রাজপথে রক্ত দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে দিনের পর দিন হয়রানি করা হচ্ছে। সেই ওয়ান ইলেভেনের সময় যে মামলাগুলো দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো আজও উঠিয়ে নেওয়া হয়নি। অথচ আওয়ামী লীগ তাদের নিজেদের মামলা নিষ্পত্তি করে ফেলেছে। বিএনপির প্রতি তাদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গেছে। আর নয়, এখন আর ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় এখন বেরিয়ে আসতে হবে। ভয়কে জয় করে তাদের পরাজিত করতে হবে। এবং একটি গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেখানে সাংবাদিকরা লিখতে পারবে। ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টে মামলা করা হবে না। সত্য লেখার জন্য কাউকে হত্যা করা হবে না। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাবি আদায় করে নিতে হবে। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করে ডিইউজের একাংশের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী।