জাতীয় সংসদের চীফ হুইপ থাকাকালীন (২০০০ সালে) বরিশাল-১ আসনের সংসদ সদস্য সরকারি অর্থায়নে এলাকার অসহায় ব্যক্তিদের সাবলম্ভী করার জন্য গরু বিতরণ করেছিলেন। যার একটি গরু পেয়েছিলেন গৌরনদী উপজেলার ভালুকশী গ্রামের অসহায় বীর মুক্তিযোদ্ধা নারায়ন ঠাকুর।
২০০১ সালের নির্বাচনের পরেরদিন সেই গরুটি পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে স্থানীয় বিএনপির দুর্ধর্ষ ক্যাডার শাহ আলী বয়াতী ও তার সহযোগিরা। অবলা ওই বোবা প্রাণীর অপরাধ ছিলো তাকে আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি দিয়েছে। এছাড়াও চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন চালানোর বিস্তার অভিযোগ রয়েছে শাহ আলী বয়াতীর বিরুদ্ধে।
পাশাপাশি ২০০১ সালের নির্বাচন পরবর্তী সময়ে প্রকাশ্যে সরকারি গৌরনদী কলেজ ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক সফিকুল ইসলাম বুলেটকে ইট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলার প্রধান আসামি দুর্ধর্ষ ছাত্রদল ক্যাডার নয়ন প্যাদা। এ দুইটি ঘটনা আজো প্রায় প্রত্যেকটি জনসভার বক্তব্যে উপমা টেনে বলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ।
অথচ সেই দুর্ধর্ষ বিএনপি নেতা শাহ আলী বয়াতী এবং ছাত্রদল ক্যাডার নয়ন প্যাদা স্থানীয় এক নেতার হাত ধরে এখন প্রভাবশালী যুবলীগ নেতা হয়েছেন। এরমধ্যে গরু চুবিয়ে হত্যা করা সেই বিএনপি নেতা শাহ আলী বয়াতী এবার স্থান পেয়েছে গৌরনদী উপজেলা যুবলীগের কমিটিতে। অপরদিকে ছাত্রলীগ নেতা বুলেট হত্যা মামলার প্রধান আসামি নয়ন প্যাদা এখন যুবলীগের অঘোষিত নিতিনির্ধারক। যা নিয়ে রিতীমতো ওই উপজেলায় চাঁপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও স্থানীয় এক নেতার ভয়ে আওয়ামী লীগের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীরা মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছেন না।
সম্প্রতি গৌরনদী উপজেলা ও পৌর যুবলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে দলের ত্যাগী ও নির্যাতিত নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করে নিচের পদে রেখে সম্পূর্ণ নিয়মবর্হিভূতভাবে সরকারি চাকরিজীবী, হত্যা মামলার আসামি ও সদ্য যোগদানকারী বিএনপি নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে রাখা হয়েছে। ফলে বিতর্কিত ওই কমিটি নিয়ে চরম অসন্তোস প্রকাশ করে ফেসবুকে মনের ভাব প্রকাশ করায় ইতোমধ্যে যুবলীগের দুইজন ত্যাগী কর্মীকে কমিটি থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। এ ঘটনার পর ভয়ে আর কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
ঘোষিত কমিটিতে দেখা গেছে, গৌরনদী উপজেলা যুবলীগের পূর্নাঙ্গ কমিটিতে পূর্বের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বহাল রয়েছেন দীর্ঘদিন থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত সৈয়দ মাহবুব আলম। কমিটির ৭ নম্বর সহসভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন গৌরনদী পৌরসভায় উচ্চমান সহকারী পদে কর্মরত এনামুল হক মিঠু। যুগ্নসাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন পৌরসভার বাজার পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত মনিরুজ্জামান মনির। সহসম্পাদক পদের মো. লিটন পৌরসভার গাড়ি চালক। কমিটির সদস্য হিসেবে রয়েছে গরু চুবিয়ে মারাসহ চারদলীয় জোট সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ওপর ব্যাপক অত্যাচার নির্যাতন চালানো শাহ আলী বয়াতী।
অপরদিকে পৌর যুবলীগের পূর্নাঙ্গ কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে স্থান পেয়েছে হত্যা মামলার আসামি আশোকাঠী গ্রামের সজিবুর রহমান জিয়া। এ ছাড়া জিয়ার আপন চাচাকেও রাখা হয়েছে উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতি পদে। উপজেলার মাহিলাড়া ইউনিয়ন যুবলীগের কমিটিতে সভাপতির পদ পেয়েছেন ভূমি অফিসের অফিস সহায়ক পদে কর্মরত রাসেল হোসেন রাঢ়ী।
উপজেলা ও পৌর যুবলীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে জানা গেছে, কমিটিতে স্থান পাওয়া অধিকাংশরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতার ঘনিষ্ট সহচর হিসেবে এলাকায় পরিচিত। ওই নেতার আশির্বাদপুষ্ট হওয়ায় দলীয় গঠণতন্ত্রের তোয়াক্কা না করে কমিটিতে তাদের স্থান দিতে বাধ্য করা হয়েছে। সূত্রটি আরও জানিয়েছেন, এখনই দলীয় কর্মকা-ে কমিটিতে স্থান দেওয়া ব্যক্তিদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা। অথচ দলের দুর্দীনে এসব সরকারি কর্মচারী, হত্যা মামলার আসামি কিংবা সদ্য যোগদানকারীদের হদিসও থাকবেনা। সূত্রের দাবি, আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শুণ্য করতেই এক নেতার খামখেয়ালীর কারণে দলের প্রকৃত নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করে বির্তকিত ব্যক্তিদের গুরুত্বপূর্ণ স্থান দেয়া হয়েছে।
সরকারি চাকরি করেও উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ পাওয়া সৈয়দ মাহবুব আলম বলেন, আমি কমিটিতে থাকার জন্য কোন প্রকার লবিং বা তদবির করিনি। তারপরেও আমাকে কমিটিতে রাখা হয়েছে। পৌরসভার কর্মচারী ও উপজেলা যুবলীগের সহসভাপতির পদে দায়িত্বে থাকা এনামুল হক মিঠুর মুঠোফোনে কল দেয়ার পর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে তা বন্ধ করে দেন। যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান মনির বলেন, উপজেলা যুবলীগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। কমিটিতে আরো ৭/৮ জন আছে যারা সরকারি চাকরি করেন। আর আমরাতো স্বায়ত্বশাষিত। তিনি আরও বলেন, অধিকাংশ পৌরসভার কর্মচারীরা রাজনীতির সাথে জড়িত। যেমন বাকেরগঞ্জ পৌরসভার বাজার পরিদর্শক ওই উপজেলার ছাত্রলীগের সভাপতি। চাকরি করে দলীয় পদে থাকা যায় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই।
এ ব্যাপারে বরিশাল জেলা যুবলীগের সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, সরকারি চাকরীজীবী কেউ যদি কমিটিতে থেকে থাকেন, আর তা যদি প্রমানিত হয়, তাহলে তিনি কমিটিতে থাকতে পারবেনা। আমরা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও উল্লেখযোগ্য পদ নির্বাচিত করে দিয়েছিলাম। বাকি পদগুলো তারা নির্বাচিত করার পর কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যেহেতু গৌরনদী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ ভাইয়ের এলাকা তাই অতোটা পুঙ্খানু পুঙ্খভাবে তদারকি করা হয়নি। এরপরেও যদি কেউ অভিযোগ দেয়, তাহলে কমিটি থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বহিস্কার করা হবে।
গৌরনদী পৌরসভার নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সফিকুল ইসলাম বলেন, এনামুল হক মিঠু উচ্চমান সহকারি ও মনিরুজ্জামান মনির বাজার পরিদর্শক হিসেবে পৌরসভায় স্থায়ীভাবে কর্মরত আছেন। তারা যে রাজনৈতিক দলের কমিটিতে আছে এ বিষয়ে কেউ লিখিত দিলে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বরিশালের জেলা প্রশাসক মোঃ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, কোন সরকারি কর্মচারী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারবেনা এবং কমিটিতেও থাকতে পারবেনা। এ বিষয়ে খোঁজখবর নিয়ে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।