রাজধানীর গণপরিবহনে চলছে নৈরাজ্য। রাজধানীর রাজপথে প্রতিদিনই বাসের ধাক্কায় কারো না কারো জীবন যাচ্ছে। বাসগুলো যেন মৃত্যুদূত। প্রশ্ন হলো কেন এত দুর্ঘটনা, এসব দুর্ঘটনার জন্য দায়ী কে ‘দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি? গাড়ি চালক? বিআরটিএ, যারা অনিয়মের মাধ্যমে যাকে ইচ্ছে গাড়ি চালানোর লাইসেন্স দিচ্ছে? ট্রাফিক ব্যবস্থা? পুরো গণপরিবহন ব্যবস্থা নাকি আইনের অপব্যবহার?’ এমন হাজারো প্রশ্ন সাধারণ মানুষের। ঢাকা শহরে যেসব গাড়ি গণপরিবহনে রয়েছে, আদৌ কি তা রাস্তায় চলার উপযোগী? অনেক গাড়ির বাইরের অবস্থা দেখেই গা ঘিনঘিন করে। ভেতরের সিট, দুই সিটের মাঝের ফাঁকা স্থানের পরিমাণ, গাড়ির বডি, জানালার কাচ, রং-এসব দেখলে বুঝতে মোটেও সমস্যা হয় না যে, এ গাড়ি রাস্তায় চলাচলের উপযোগী নয়। বিশ্বের কোনো দেশের রাজধানী শহরে এমন বিবর্ণ, জোড়াতালি দেওয়া, ভাঙাচোরা ফিটনেসবিহীন গাড়ি চলাচল করে না। কিন্তু উন্নয়নশীল দেশের পথে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মহানগরীতে নির্বিঘ্নে চলছে এসব গাড়ি। ফিটনেসবিহীন এসব গাড়ি নাকি পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে চালানো হয়। এসব গাড়ির চালকের স্বেচ্ছাচারিতায় ট্রাফিক পুলিশটিকেও জীবন হারাতে হয়। একটু লক্ষ করলেই দেখা যাবে, এসব গণপরিবহনের চালকের আসনে স্টিয়ারিং ধরে বসে আছে কোনো কিশোর। এ বয়সে গাড়িচালকের লাইসেন্স তার পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু পেয়ে গেছে। অথবা ওই কিশোর গাড়ির হেলপার, কোনো লাইসেন্সই নেই। প্রকৃত চালক বিশ্রাম নিচ্ছে, এ ফাঁকে সে একটা ট্রিপ চালাচ্ছে। আবার গাড়িচালকদের অনেকেই মাদকসেবী। নিজেদের শরীরের ওপরই এদের নিয়ন্ত্রণ নেই। জানা যায়, দেশে বৈধ যানবাহন ১৩ লাখের বেশি। আর বৈধ চালকের সংখ্যা মাত্র আট লাখ। লাইসেন্সবিহীন অদক্ষ অবৈধ কত চালক গাড়ি চালায়, তার কোনো সঠিক হিসাব নেই। এসব চালকের হাতে যাত্রী বা পথচারীর জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অধিক মুনাফার লোভে চালকেরা পরস্পর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। ফলে ওভারটেকিং করে নিয়ম-কানুনকে ও তোয়াক্কা করে না। আর এর ফল হিসেবে বাসযাত্রীদের জীবন বিপন্ন হয়। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। ঢাকা মহানগরীতে নির্ধারিত স্থানের বাইরে গাড়ি থামত না। অর্থাৎ যাত্রীদের বাসস্ট্যান্ড থেকে উঠতে হতো এবং বাসস্ট্যান্ডেই নামতে হতো। কিন্তু এখন ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা দেখে মনে হয়, পুরো ঢাকা শহরই যেন বাসস্ট্যান্ড। যেখানে যাত্রী পাঁচ্ছে, সেখান থেকেই তুলছে। আবার যেখানে যাত্রীর ইচ্ছা, সেখানেই নামিয়ে দিচ্ছে। এজন্য ওই গাড়িটি রাস্তার পাশেও চাপানো হচ্ছে না। রাস্তার মাঝখানেই যাত্রী ওঠানো বা নামানো হচ্ছে। এভাবে যাত্রী ওঠানো-নামানো যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ, তা গাড়িচালক, গাড়ির হেলপার এমনকি ওই যাত্রীরও ধারণা নেই। এ ছাড়া এভাবে যত্রতত্র গাড়ি দাঁড় করানোর ফলে তার পেছনে যে অসংখ্য গাড়ি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, সেদিকেও ভ্রুক্ষেপ নেই গাড়িচালকের। রাস্তার মধ্যে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানোর পর যেকোনো সময় পিছন থেকে আসা আরেকটি বাসের নিচে জীবন চলে যাচ্ছে যাত্রীর। একই সঙ্গে সড়ক দুর্ঘটনায় পথচারীদের অসতর্কতাকেও দায়ী মনে করা হয়। সড়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে গাড়িচালক ও পথচারীর অসতর্কতা ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের ৭২ শতাংশই পথচারী। সারা দেশে যত দুর্ঘটনা ঘটে, তার জন্য পথচারীরাও অনেকাংশে দায়ী। পথচারীরা যদি সতর্কতার সঙ্গে রাস্তা পার হয়, তাহলে প্রাণহানির সংখ্যা কমে আসবে। যানবাহনে অতিরিক্ত যাত্রী হওয়া, ট্রাকে যাত্রী হওয়া, ট্রাকের পণ্যের ওপর যাত্রী হওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সরকারের পাশাপাশি পথচারী, ট্রাফিক পুলিশ, পরিবহন মালিক ও চালকের দায়িত্ববোধ ও আন্তরিক সচেতনতার সমন্বয়ই পারে সড়ক দুর্ঘটনা সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে।