বাংলাদেশে বর্তমানে ৮৫৭ টি নদী রয়েছে। কিন্তু অনেক নদীরই নেই নাব্যতা, বেশ কিছু নদী একেবারেই পর্যুদস্ত অবস্থায় পড়ে গেছে। নদীর আশপাশে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে রেখেছে অনেক জায়গা। আবার শুকনো মৌসুমে কিছু নদীকে বলা হয় মৃত নদী। যেসব নদী বড় বড় শহরগুলোর আশপাশ বা ভেতর দিয়ে গেছে সেগুলোই এই মৌসুমে পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। উচ্চ আদালত থেকে বার বার নির্দেশনা এসেছে দীগুলোকে দখল ও দূষণ-মুক্ত করার জন্য। সরকারও প্রায়ই নদীর ওপর অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করছে কিন্তু পরক্ষণেই আবার নদীগুলো দখল হচ্ছে। নদী দখল করা ও দূষণ ছড়ানো এসব ফৌজদারি অপরাধের মধ্যে পড়ে। আর তাই ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে এক্ষেত্রে। পাশাপাশি নদীরক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য রয়েছে আদালতের রায় ও নির্দেশনা। তবু দেশে নদীর ওপর নির্যাতন বেড়ে চলছে। দিনে দিনে বৃদ্ধি পাঁচ্ছে দখলদার। পানি হচ্ছে দূষিত থেকে দূষিততর। বিশেষজ্ঞরা জানান, হাইকোর্ট নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে কিন্তু তাতে প্রাণ পাঁচ্ছে না নদী। দখল-দূষণের দায়ে ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার আইন থাকলেও এখন পর্যন্ত কারও দণ্ড হয়নি। অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য বছরব্যাপী ব্যাপক কার্যক্রম (ক্র্যাশ প্রোগ্রাম) ঘোষণার মধ্যেও থামছে না দখল। বাংলাদেশ দুর্যোগ ফোরামের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৬৩ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ৩৭ বছরে দেশের ১১৫টি নদ ও নদী শুকিয়ে মৃতপ্রায়। অন্য দিকে নদী, পানি-প্রকৃতি নিয়ে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কাজ করা বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন উত্তরণের সমীক্ষা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে (২০০০ থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত) দেশে ৪৩টি নদী শুকিয়ে গেছে। নদী রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলো দায়িত্ব পালন না করে সরকারি সুবিধা নিয়ে যাচ্ছে। নদী দখলদাররা টিকে থাকলে তাদের লাভ আছে। গোপনে দখলদারদের সঙ্গে হয়তো লেনদেনও চলে এসব কর্মকর্তাদের। ২০১৯ সালে নদীর ৫৭ হাজার ৩৯০ জন দখলদার চিহ্নিত করে ১৮ হাজার ৫৭৯ জনকে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু ২০২০ সালে দখলদারের সংখ্যা আরো বেড়ে হয়ে যায় ৬৩ হাজার ২৪৯ জন। নদী রক্ষা কমিশনের এক সমীক্ষায় সবচেয়ে বেশি চার হাজার ৭০৭টি স্থাপনা পাওয়া যায় কীর্তনখোলা নদীতে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পাওয়া গেছে দুই হাজার ৪৯৩টি স্থাপনা, ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ৮৯৪টি, ধলেশ্বরীতে ৮৮৬টি, তুরাগ নদে ৬৬১টি এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪৬৮টি অবৈধ স্থাপনার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। এ ছাড়া করতোয়ায় ৮০৭, কক্সবাজারের বাঁকখালীতে ২১৮, গোমতীতে দুই হাজার ১২০টি, পার্বত্য জেলার সাঙ্গুতে ৩৩৩ স্থাপনাসহ আরও কিছু নদীতে অবৈধ স্থাপনার তালিকা করা হয়। তবে ওই তালিকায় সব জেলার তথ্য তখন পাওয়া যায়নি। এরপর আর তালিকা নিয়ে কাজ হয়নি। নদী রক্ষা কমিশন বলছে, ২০২১ সালের ১৮ নভেম্বর নৌ প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সংসদকে ওই তালিকার তথ্যই জানিয়ে বলেন, তালিকা ধরে উচ্ছেদ অভিযান চলছে। তিনি সংসদকে জানান, তখন পর্যন্ত নদী তীরবর্তী ২১ হাজার ৪৪৩টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে, উদ্ধার করা হয়েছে ৭২৩.৬২ একর জমি। সারা দেশে ১৯ হাজার ৮৭৪ জন অবৈধ নদী দখলদারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। যেখানে ঢাকা নদী বন্দরে ১৬ হাজার ৪২৪টি, নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরে চার হাজার ৭৬৯টি, বরিশাল নদী বন্দরে ১৪১টি, আশুগঞ্জে ৫০টি এবং নওয়াপাড়া নদী বন্দর থেকে ৫৯টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, সাধারণ মানুষ নদী দখল করে না। যারা নদী দখল করে, তারা হয় ব্যবসায়ী না হয় রাজনৈতিক নেতা অথবা কোনা প্রভাবশালী ব্যক্তি। আর ওই প্রভাবশালীরাই নানা কৌশলে দখল বহাল রাখতে চায়। তিনি আরও বলেন, আমি একাধিক দখলদার পেয়েছি যারা সংসদ সদস্য। দখল উচ্ছেদ করার প্রধান দায়িত্ব জেলা প্রশাসকদের ও এর মধ্যে আইনে আরও ১৭ ধরনের সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব আছে। তারা সেটা না করে উল্টো দখলদারদের সহায়তা করে থাকে।