আমাদের সমাজে ইদানীং বৃদ্ধ পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্য বোধের অনেক ঘাটতি রয়েছে। যে বাবা-মা অনেক কষ্ট করে নিজ সন্তানকে আদর-স্নেহ দিয়ে বড় করে তুললেন, তাদের প্রতি এ যেন জঘন্য আচরণ ক্ষমার অযোগ্য। যে বাবা নিজে না খেয়ে সন্তানকে বড় করলেন- পরবর্তীকালে যে সন্তান জীবনে প্রতিষ্ঠিত হলো সেই সন্তান যদি বৃদ্ধ বয়সে বাবা মায়ের সেবা যত্ন না করেন- খোঁজ খবর না নেন তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা এই পৃথিবীতে আর কি হতে পারে? তবে আমাদের সমাজে ইদানীং এ রকম অবাঞ্ছিত অহরহ ঘটছে। এখনকার পরিবারগুলো অধিকাংশই মা-বাবা এবং সন্তানদের নিয়ে একক পরিবার। এখনকার বর্ধিত একক পরিবারে বৃদ্ধদের সাধারণত জায়গা হয় না। যদি আর কোনো উপায় না থাকার কারণে তাঁরা জায়গা পানও, আদর সম্মান পান না। পশ্চিমা বিশ্বে বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া খুব সাধারণ একটি ব্যাপার, বিশেষ করে কেউ যখন তাঁর নিজের কাজগুলো আর নিজে করতে পারেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বৃদ্ধাশ্রমে তাঁরা নিজের ইচ্ছাতেই যান। তার কারণ বিবিধ। অনেকে এতটাই স্বাধীনচেতা যে বৃদ্ধ বয়সেও ছেলে-মেয়ে বা পরিবারের অন্য কারও ওপর নির্ভরশীল হতে চান না।
কেউ কেউ হয়তো বিয়েই করেননি বা সন্তান নেননি বা সঙ্গী বেঁচে নেই, তাই একাকিত্বে ভোগেন। কারও কারও ছেলেমেয়েরা হয়তো তাঁদের জীবন-জীবিকা নিয়ে এত ব্যস্ত, বৃদ্ধ মা-বাবাকে চাইলেও কাছে রাখার উপায় নেই। তা ছাড়া উন্নত দেশগুলোতে, বাসায় একজন দক্ষ সেবা প্রদানকারী রাখা প্রচণ্ড ব্যয়সাধ্য ব্যাপার। বেশির ভাগ মানুষের পক্ষেই সেই ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমে থাকলে, একদিকে যেমন তাঁদের থাকা, খাওয়া, চিকিৎসা ইত্যাদি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না, অন্যদিকে তেমনই তাঁরা পেয়ে যান অনেক সমবয়সী বা কাছাকাছি বয়সের মানুষদের, যাঁদের সঙ্গে তাঁদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। অবসরে গল্পগুজব, সুখ-দুঃখের আলাপ করে সময় কাটে। আবার নিয়মিতভাবে বয়স এবং স্বাস্থ্য উপযোগী বিভিন্ন রকম ব্যায়াম, খেলাধুলা, ভ্রমণ ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকেন তাঁরা। নির্দিষ্ট সময়ে, বিশেষ করে ছুটির দিনগুলোতে ছেলেমেয়ে, আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবেরা আসেন দেখা করতে। সঙ্গে নিয়ে আসেন তাঁদের পছন্দের খাবার বা অন্য কোনো উপহার। সব মিলিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে তাঁরা আনন্দেই থাকেন। আমাদের দেশে অনেক সময় সন্তানদের দেখা যায়, যাঁরা নিজেদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত চিকিৎসা এবং যতেœর অভাবে অন্ধ হয়ে যাওয়া অসহায় বিধবা মাকে নিজেদের কাছে তো রাখেনই না, সামাজিক ও পারিবারিক কলঙ্কের ভয়ে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমেও দেন না। ফেলে রাখেন অযত্ন, অবহেলায়।
অনেকে আবার বেড়ানোর নাম করে রেখে আসেন বৃদ্ধাশ্রমে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান হয় বৃদ্ধাশ্রম নামক কারাগারে। হৃদয়ফাটা কান্না আর আহাজারী যেন আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হ’তে থাকে। খোঁজ নিয়ে জানা যায় পরিবারের সদস্যদের বনিবনার অভাবেই এ কাজ করেছে। তারপর সেই মা-বাবার আর খোঁজখবর তো নেনই না, মৃত্যুর সংবাদ পেলেও শেষ দেখাটা পর্যন্ত দেখতে আসেন না। এছাড়াও হাতে গোনা কিছু ছাড়া, অধিকাংশ বৃদ্ধাশ্রমেই সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাশিত মানের নয়। প্রায় সব কটি বৃদ্ধাশ্রমেই থাকার জন্য মাসিক ফি দিতে হয়। যত বেশি ফি, সেবার গুণগত মান তত উন্নত। অনুপযুক্ত অবকাঠামো, নার্স এবং পরিচর্যাকারীসহ প্রশিক্ষিত কর্মীদের ঘাটতি, নিম্ন মানের খাদ্য, অপর্যাপ্ত শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদনমূলক এবং সামাজিক কার্যক্রমের অভাব, এমনকি প্রবীণদের প্রতি দুর্ব্যবহার, অবহেলা এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কিছু ঘটনা মাঝেমধ্যেই জনসমক্ষে বেরিয়ে আসে। তাই আমাদের দেশে এ পদ্ধতিটি স্বীকৃত কোনো পদ্ধতি বা স্বাভাবিক কোনো বিষয় হয়ে উঠার আগেই এ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পাল্টাতে হবে মানসিক পরিবর্তন, সামাজিক অনুশাসন, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রসার, নৈতিক মূল্যবোধ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। শেষ বয়সে প্রতিটি বৃদ্ধ মানুষের ঠাঁই যেন হয় পরিবারে। আরাম-আয়েশে থাকার অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে সরকারকেও আইনের মাধ্যমে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাতে করে একটা সময় আর কাউকে বৃদ্ধাশ্রমে শেষ বয়সে যেতে হবে না।