অভাবের সংসারে দেড় বছরের ব্যবধানে জন্ম নেয় দুই সন্তান। তাদের দুধ ঠিকমতো পাওয়া যেত না। বাচ্চাদের দুধের চাহিদা মেটানোর জন্য ঋণ নিয়ে একটি গাভী কেনা হয়। এখন তাঁরা সফল খামারী। প্রতিদিন আয় সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। তাদের দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে অন্তত ২০জন খামার গড়ে তুলেছেন।
দম্পতির নাম রফিকুল ইসলাম (৪০) ও শিউলি আক্তার (৩৮)। বাড়ি রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দি উপজেলার বালিয়াকান্দি সদর ইউনিয়নের ইকরচর গ্রামে। তাদের বড় ছেলে তরিকুল বালিয়াকান্দি সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণি ও ছোট ছেলে তৌহিদুল বালিয়াকান্দি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জণ করায় ২০১৬ সালে ঢাকা বিভাগীয় পর্যায়ে পেয়েছেন সেরা জয়িতার সম্মাননা পেয়েছে শিউলী আক্তার।
সরেজমিনে দেখা যায়, বালিয়াকান্দি-জামালপুর সড়কের শ্রীরামপুর বাজার থেকে একটি হেরিংবোম রাস্তা হাতের দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। রাস্তা দিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর রফিকুল ইসলামের বাড়ি। বাড়ির প্রথমে তাদের থাকার ঘর। পরে বড় একটি গোয়াল ঘর। প্রাচীরে ইটের গাঁথুনি। এরপর বাতাস আসার জন্য নেট দেওয়া হয়েছে। উপরের অংশে টিন দেওয়া। মেঝে পাকা। উপরে ফ্যান। একপাশে জেনোরেটর। এল আকৃতির ঘরের একদিকে বাঁছুর রাখা।
রফিকুল-শিউলী দম্পতির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয় রফিকুল ও শিউলীর। চার ভাইয়ের মধ্যে রফিকুল মেঝো। একান্নবর্তী সংসার ছিল বাড়িতে। বড় ভাই চিকিৎসক। রফিকুল বাড়ি কৃষিকাজ দেখভাল করেন। ট্রাক্টর চালাতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ধান, গম মাড়াইতেও খুব দক্ষ। তবে বড় ভাইয়ের আগে বিয়ে করায় পারিবারিক ভাবে মনোমালিন্য সৃষ্টি হয়। মাঝেমধ্যে বাবা ও ভাইদের সঙ্গে পারিবারিক কলহ তৈরি হতো। প্রথম সন্তান জন্মের সংসার থেকে আলাদা করে দেওয়া হয়।
থাকার জন্য ঘর থাকলেও কোনো সম্পত্তি বা টাকাপয়সা ছিলনা। কৃষিশ্রমিক হিসেবে অন্যের জমিতে কাজ করে কাটছিল তাঁর সংসার। দেড় বছরের ব্যবধানে তাদের আরেকটি সন্তান হয়। দুই ছেলের জন্য প্রতিদিন প্রায় তিন কেজি দুধ প্রয়োজন হতো। কিন্তু প্রতিবেশী গাভীওয়ালাদের কাছ থেকে ঠিকমতো দুধ পাওয়া যেতো না। শিউলীর অনুরোধে ঋণ নিয়ে একটি বাছুরসহ একটি গাভী কেনা হয়।
রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে গাভী পালনের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে ছিলাম। যুব উন্নয়ন থেকে গাভী কেনার জন্য আঠারো হাজার টাকা ঋণ নেই। পাশের গ্রাম থেকে বাছুরসহ একটি গাভী কিনি। গাভীটা ছিল কিছুটা রোগা। আমরা দুইজন মিলে গাভীর খুব যতœ শুরু করি। গাভীটির স্বাস্থ্য ভালো হতে থাকে। কিছুদিন পরে গাভীটি আবারও বাচ্চা দেয়। এবার দুধের পরিমান আগের চেয়ে বেড়ে যায়। এরপর আমাদের আর পিছনের দিকে তাকাতে হয়নি। আস্তে আস্তে আমাদের দুধের পরিমান বাড়তে থাকে। গরুর সংখ্যাও বাড়তে থাকে।
তিনি বলেন, প্রথমে গোয়ালঘর তৈরির টাকা ছিল না। পলেথিন দিয়ে গোয়াল ঘর তুলি। ঘর যেমনই হোক, যত্মের কোন কমতি ছিল না। এরপর সেই গাভী ও গাভীর বাচ্চা থেকেও নতুন বাছুর জন্ম নেওয়া শুরু করে। দুধ বাজারে বিক্রি করে টাকা জমতে থাকে। এরপর পলেথিনের ঘরের স্থলে টিন দিয়ে ঘর দেই। দোচালা ঘর। উভয়পাশে ১০টি করে টিন। বেশ বড় ঘর। মেঝে পাকা করে দেই। এরপর থেকে কয়েক দফায় ঘর সম্প্রসারণ করেছি।
রফিকুল ইসলাম বলেন, রাজবাড়ীর বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও কুষ্টিয়া, মাগুরা, যশোরের বিভিন্ন খামার বা কৃষকের বাড়ি থেকে গাভী কিনি। বাড়িতে এনে কিছুদিন লালন পালন করি। কেউ পচ্ছন্দ করলে বিক্রি করে দেই। এবছর ছয়টি গাভী বিক্রি করেছি। দাম পেয়েছি সাড়ে তের লাখ টাকা। সাড়ে সাত লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। আরেকটা জমির বায়না দিয়েছি। বাড়িতে আমাদের ছোট-বড় দিয়ে গরু আছে ২০টি। বাজারে দাম যাবে অন্তত পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ লাখ টাকা। আর মাঠে ১০ বিঘা জমি কিনেছি। দাম অন্তত ৪০ লাখ টাকা। বাড়িতে ঘর দিয়েছি।
কিছুদিন আগে তিন লাখ ৪০ হাজার টাকায় একটি গাভী বিক্রি করেছি। সেটি কিনেছিলাম তিন লাখ ৯৪ হাজার টাকায়। কেনার কয়েকমাস পরে বাচ্চা হয়েছে। গাভীর বাছুরের দাম এখন হবে ৮০ হাজার টাকা। দুধ বিক্রি করে খরচবাদে লাভ হয়েছে অন্তত এক লাখ টাকা।
খামারের পাশাপাশি চাষাবাদও করি। সাধারণত ২০টি গরুই রাখি। বেশি হলে বিক্রি করে দেই। সকালে স্বামী-স্ত্রী দুইজনই খামারে সময় দেই। ঘাস কাটার জন্য একজন স্থায়ী শ্রমিক আছে। আর বিশেষ সময়গুলোতে একাধিক শ্রমিক নিয়োগ করি। এখন প্রতিদিন ২০০লিটার দুধ বিক্রি করি। তবে মাঝেমধ্যে দুধের পরিমান আরও বেশি হয়।
শিউলী আক্তার বলেন, আমরা আমাদের সন্তানদের মতোই গরু লালনপালন করি। কেউ কিনতে আসলে তাদের ব্যাপারে ভালো মতো খোঁজখবর নেই। ক্রেতার গৃহিনী গরুর প্রতি যতœশীল না হলে বিক্রি করিনা। আমাদের খামারের গরু পরের খামারেও ভালো থাকবে কিনা সেটি নিশ্চিত হলেই গরু বিক্রি করি। আমাদের দেখাদেখি অনেকেই খামার করেছে। আমার ছোট জা’ও একটি খামার করেছে। এখন তাঁর খামারে পাঁচটি গরু রয়েছে। এ ছাড়া অনেকগুলো বিক্রি করেছে।
সেলিনা খাতুন বলেন, আমার স্বামী বিদেশ থাকে। ভাবীদের দেখে আমিও খামার করার প্ল্যান করি। আমার বাবার বাড়ি থেকে একটি গরু কিনি। পল্লী সঞ্চয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভাসুরের কাছ থেকে আরেকটি গাভী কিনি। এখন আমার টাকার জন্য বিদেশের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়না। মাঠে ঘাষ চাষ করা হয়েছে। গরুর সংখ্যা বেশি হলে বিক্রি করে দেই। আর সারাবছর দুধ বিক্রি করি।
বালিয়াকান্দি পল্লী সঞ্চয় ব্যাংকের কর্মকর্তা বিধান কুমার দাস বলেন, শিউলী আক্তার আমাদের একজন গ্রাহক। প্রথমে ১০ হাজার টাকার ঋণ নিয়ে ছিল। এরপর বিভিন্ন অংশের ঋণ নিয়েছে। এখন তার একলাখ টাকার একটি ঋণ আছে। তিনি নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেন। তাঁর দেখাদেখি ওই এলাকায় অনেকের গরু চাষ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।