পদ্মা সেতুর বদৌলতে পাল্টে গেছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতির গতিপথ। যাতায়াত ব্যবস্থার মাইলফলক উন্নয়নে একের পর এক কলকারখানা গড়তে বিনিয়োগ হচ্ছে বরিশালে। মাত্র একবছরের ব্যবধানে নতুন নতুন শিল্প স্থাপনে আগ্রহী হচ্ছেন উদ্যোক্তারা।
বরিশাল বিভাগের জন্য এক ধরনের গলার কাঁটা ছিল পদ্মা নদী। শতাব্দীকালেরও বেশি সময় ধরে এই নদীর ভয়াল ইতিহাসের ছাপ পরেছিল দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জীবনযাত্রায়। অভিশপ্ত সেই জীবনের গল্প আজ অতীতে রূপ নিয়েছে। দেশ-বিদেশের নানা ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার দুরদর্শীতার কারণে স্বপ্নের পদ্মা সেতু আজ সক্ষমতায় কীর্তিনাশা জয়ের ইতিহাস লেখা শুরু হয়েছে।
২০২২ সালের ২৫ জুন উদ্বোধণ হয়েছিল দক্ষিণাঞ্চলবাসীর বহুল কাঙ্খিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এরপর মাত্র ৩৬৫ দিন পার হতে না হতেই বদলাতে শুরু করেছে চির অবহেলিত বাংলার শস্যভান্ডার বরিশাল। পর্যটন, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, চিকিৎসা, যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসাখাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জনপদ ভিত্তিক উন্নয়নে ফিরেছে অভাবনীয় গতি। এখন আর কেউ পদ্মার এপার-ওপার বলে বিভাজন করতে পারছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর কারণে বরিশাল বিসিক শিল্প এলাকার বর্ধিত অংশে ইতোমধ্যে ৭৪ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্পে ৩৭ একর নিচু জমি ভরাট করে ১১০টি প্লট করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যার ৩০টি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত প্লট পেতে আবেদন জমা পরছে। ব্যবসায়ীদেরা দাবি, রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশের সাথে যোগাযোগের মাইলফলকে বরিশালে প্রথমবারের মতো বিসিকে পোশাক তৈরির (গামের্ন্টস) কারখানা, বোতলজাত পানি পরিশোধনাগার ও কমফোর্টারের কারখানা গড়ে উঠেছে। নদী ঘেরা বরিশালের রূপালী ইলিশ শুধু সারাদেশেই নয়, একদিনের মধ্যে চলে যাচ্ছে ভারতের কলকাতায়। বরিশালে একের পর এক শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এসবই সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুরদর্শী উদ্যোগ দেশের টাকায় নির্মিত পদ্মা সেতুর কারণে।
পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে পণ্য রপ্তানির দ্বার উন্মোচন হয়েছে উল্লেখ করে শামীম মোল্লা নামের বরিশালের এক ব্যবসায়ী বলেন, আমরা আশা করছি, আমাদের ক্রয়াদেশ আরও বাড়বে। ফলে আমাদের ব্যবসা আরও প্রসারিত হবে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু শুধু আমাদের বরিশালের নয়; পুরো দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা উপকৃত হয়েছেন।
সম্প্রীতি বরিশালের সাধারণ সম্পাদক ডা. সুদীপ কুমার হালদার বলেন, ভাঙ্গা থেকে বরিশাল পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশের কোনো প্লট এখন আর খালি নেই। সব শিল্প উদ্যোক্তারা নিয়েছেন। তারা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। পর্যায়ক্রমে দেখা যাবে বরিশালের বেকারত্বের হার নেমে আসছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর পুরোপুরি সুফল আসবে যখন ভাঙ্গা থেকে পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটা পর্যন্ত ফোরলেন সড়কের কাজ সম্পন্ন হবে। যা ইতোমধ্যে অনেকাংশে কাজও এগিয়ে চলছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তবে ভোলা থেকে পাইপলাইনে স্থানীয়ভাবে গ্যাস সরবরাহ না হলে প্রত্যাশিত শিল্প উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্থ হবে বলে মনে করছেন সচেতন বরিশালবাসী। এ বিষয়ে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জ্যোতির্ময় বিশ্বাস বলেন, দক্ষিণাঞ্চলের ভোলায় যে গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, সেই গ্যাস যদি দক্ষিণ বা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলজুড়ে ব্যবহার করা যায়, তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি আরও অনেক বেশি ত্বরান্বিত হবে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতুর কারণে সবচেয়ে বেশি সফল হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের বেকার তরুণরা। একদিকে যেমন নানা কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে, অন্যদিকে প্রভাব পরছে অর্থনীতিতেও। যোগাযোগব্যবস্থা আরও ভালো হওয়ার পাশাপাশি নিত্যনতুন কারখানা গড়ে উঠলে দক্ষিণাঞ্চল একসময় দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
বরিশাল চেম্বার অব কমার্সের প্রেসিডেন্ট সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর প্রভাবে বরিশালের সামগ্রিক চিত্র পাল্টে গেছে। আমরা সবদিক দিয়ে উপকৃত হয়েছি। তবে শিল্প উন্নয়নে এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে গ্যাস। ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে দ্রুত বরিশালে আসবে বলে আমরা শতভাগ আশাবাদি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতায় ব্যবসায়ীদের কথা চিন্তা করে দ্রুত এ কাজ বাস্তবায়ন করা হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। সাইদুর রহমান রিন্টু আরও বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর মাত্র একবছরের মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিকখাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। ইতোমধ্যে শুধু বরিশালেই প্রায় অর্ধশত শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। এতে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
সড়কপথে স্বর্ণালী অধ্যায়, পথে বসেছে লঞ্চ ব্যবসা ॥ পদ্মা সেতুর কারণে পর্যটন, অর্থনীতি, সামাজিক প্রেক্ষাপট, চিকিৎসা, যোগাযোগ, শিক্ষা, ব্যবসাখাতে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। জনপদ ভিত্তিক উন্নয়নে অভাবনীয় গতি ফিরেছে। পাশাপাশি সেতু চালুর পরপরই মন্দায় পরেছে লঞ্চ ব্যবসায়ীরা। বন্ধ হয়ে গেছে অভ্যন্তরীণ সিংহভাগ নৌরুট। ঢাকা-বরিশাল নৌরুটও ধুঁকছে যাত্রী সংকটে। অর্থাৎ পদ্মা সেতুর কারণে সড়কপথে জমজমাট হয়ে উঠছে জীবনযাত্রা, বিপরীতে নৌপথে ব্যবসা বিধ্বস্ত। আবার সড়কে গাড়ির চাঁপ বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে, সেই সাথে বেড়েছে প্রাণহানিও।
নদীবেষ্টিত বিভাগ ॥ ১৩ হাজার ২২৫ বর্গকিলোমিটার নদীবেষ্টিত ছয়টি জেলা নিয়ে ১৯৯৩ সালে বরিশাল বিভাগ গঠিত হয়। ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বিভাগের মোট জনসংখ্যা ৮৩ লাখ ২৫ হাজার ৬৬৬ জন। আদমশুমারি পরবর্তী ১২ বছরে তা আরও বেড়েছে। ইতিহাস, ঐতিহ্য সমৃদ্ধ বরিশাল বিভাগে পর্যটনের জন্য রয়েছে অপার সম্ভাবনা। তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও রয়েছে অনেক সুযোগ। কিন্তু যুগ যুগ ধরে তার বিকাশ হয়নি নিরবিচ্ছিন্ন যোগাযোগের জন্য। মূলত রাজধানী ঢাকার সাথে যাতায়াতে পদ্মা নদী পারাপার হওয়া ছিল চরম ভোগান্তি আর বিড়ম্বনার। তেমনি লঞ্চে যোগাযোগ ছিলো দীর্ঘসময় অপচয়। আগে দক্ষিণাঞ্চল থেকে ঢাকায় পণ্য পৌঁছাতে ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগতো। সেখানে এখন বিভাগের সর্বদক্ষিণের পটুয়াখালী জেলা থেকে পাঁচ ঘন্টায় পণ্য পৌঁছে যাচ্ছে। আর যাতায়াতে পটুয়াখালী থেকে সর্বোচ্চ চার থেকে সাড়ে চারঘন্টা সময় লাগে।
সুফল ॥ বরিশাল নগরীর পোর্ট রোডের ব্যবসায়ী ইলিয়াস হোসেন বলেন, লঞ্চে পণ্য পরিবহনে খরচ কিছুটা কম হলেও সড়কপথে এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে নিরাপদে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মালামাল পৌঁছে দিতে পারছি। এতে আমাদের ব্যবসার গতি বেড়েছে। তিনি আরও বলেন, পদ্মা সেতু চালুর আগে ট্রাকের জন্য অপেক্ষায় থাকতে হতো। এখন আর সেই ঝামেলাও নেই। ট্রাক শ্রমিক পলাশ বেপারী বলেন, সারাদিন মালামাল লোড আনলোড করেই দিন পার হয়ে যায়। আগেদিনে পাঁচশ’ টাকা আয় হলেও এখন প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয়। বরিশাল শিল্প নগরীর শিল্প উদ্যোক্তা সমিতির সভাপতি মিজানুর রহমান বলেন, আমরা যারা চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসার সাথে জড়িত, তাদের কাছে পদ্মা সেতু আশীর্বাদ। তিনি আরও বলেন, আমার ফরচুন সুজ কোম্পানির উৎপাদিত সকল জুতা দেশের বাইরে রপ্তানি হয়। যা চট্টগ্রাম পোর্টের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়। আগে বরিশাল থেকে একটি কাভার্ডভ্যান কিংবা ট্রাক পোর্টে গিয়ে পৌঁছাতে কমপক্ষে তিনদিন সময় লাগতো। কোনো ক্ষেত্রে ছয় থেকে সাতদিনও লেগে যেতো। পদ্মা সেতু চালুর পর এখন একদিনের মধ্যেই বরিশাল থেকে চট্টগ্রাম পোর্টে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছ। ফলে পরিবহন খরচ অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে।
বিলাসবহুল পরিবহন ॥ পদ্মা সেতু চালুর পর সড়কপথে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। একের পর এক বিলাসবহুল বাস সার্ভিস যুক্ত হচ্ছে ঢাকা-বরিশাল রুটে। সোহাগ ক্ল্যাসিক, গ্রিনলাইন, ইউরো কোচ, শ্যামলী, এনআর ট্রাভেলস, সাকুরা, ইলিশ, প্রচেষ্টা, এনা, সুপার সনি, গ্রিন সেন্ট মার্টিন, ইউনিক পরিবহনের মতো নামিদামি পরিবহনগুলো যুক্ত হওয়ায় স্বাচ্ছন্দ্যে আরামের ভ্রমণ করছেন দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা।
বেড়েছে দূর্ঘটনা ॥ পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা-বরিশাল রুটে পূর্বের তুলনায় চারগুন যানবাহন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত পূর্বের সরু সড়ক দিয়েই সকল যানবাহনকে চলাচল করতে হচ্ছে। যেকারণে সড়কে গাড়ির চাঁপ বৃদ্ধি পাওয়ায় দুর্ঘটনার পাশাপাশি প্রাণহানির ঘটনাও বেড়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে ভাঙ্গা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত মহাসড়কটি ফোর লেনে উন্নীত করণে সর্বমহলে জোর দাবি উঠেছে। দুর্ঘটনার বিষয়ে বরিশাল ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মিজানুর রহমান বলেন, বিগত দশ মাস আমি বরিশালের দায়িত্বে রয়েছি। আগের বছরের তুলনায় সর্বশেষ দশ মাসের হিসেব পর্যালোচনা করলে সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা দ্বিগুন হয়েছে। এজন্য তিনটি কারণকে দায়ী করে তিনি বলেন, প্রথমত চালকদের অদক্ষতা, দ্বিতীয়ত যান্ত্রিক ত্রুটি এবং তৃতীয়তো বরিশাল বিভাগের সরু মহাসড়ক। ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে পর্যন্ত গতি নিয়ে গাড়িগুলো এসেই সরু সড়কে প্রবেশ করে সেই একইগতিতে চালানোর চেষ্ঠা করেন। ফলে একদিকে গাড়ির চাঁপ অন্যদিকে অপ্রশস্ত সড়ক দুর্ঘটনার বড় একটি কারণ।