চিকিৎসকদেরকে স্পষ্টাক্ষরে পাঠোপযোগী ব্যবস্থাপত্র (প্রেসক্রিপশন) লেখার নির্দেশ থাকলেও বাস্তবে তার কোনো কার্যকারিতা নেই। অস্পষ্ট ব্যবস্থাপত্র বর্তমানে একটি জাতীয় এমনকি আন্তর্জাতিক সমস্যাও বলা যায়। প্রতিবছর ১৫ লক্ষ রোগী অনাকাক্সিক্ষতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে ডাক্তারদের হাতের লেখার অস্পষ্টতায় ভুল ঔষুধ সেবনের কারণে। আমেরিকার ইনস্টিটিউট অফ মেডিসিন আইওএম এর প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৭ হাজার রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয় প্রেসক্রিপশনে চিকিৎসকদের হাতের লেখা বুঝতে না পারার ফলে। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ২০১৩ সালের নভেম্বর থেকে ২০১৬ সালের নভেম্বর পর্যন্ত অভিযোগ জমা পড়েছে ১ হাজার ১০২টি। একটি ব্যবস্থাপত্রে যদি কোনো একটি শব্দ অস্পষ্ট থাকে তাহলে বানান এদিক সেদিক হতে পানে। আর বানান এদিক সেদিক হলে ঔষদের নাম বা প্রোডাক্ট নাম, জেনেরিক বা গ্রুপ নাম ও ব্র্যান্ড পরিবর্তন হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকের হাতের লেখা বুঝতে না পারায় কিছু সময় গোলযোগ বেঁধে যায়। অনেক ক্ষেত্রে একজন ফার্মাসিস্ট তার অজান্তেই ভুল ঔষধ দিয়ে থাকে। এসব ভুল ঔষধ সেবনের মাধ্যমে রোগীর অনেক ধরনের ক্ষতি হতে পারে। সাধারণত চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন লেখার সময় এত তাড়াহুড়ো করে যে তাদের লেখা বোঝার কোনো উপায় থাকে না। অনেক ডাক্তার আছেন যারা অনেক পরিচিত বা জনপ্রিয় তাদের কাছে অনেক রোগীই ভীড় করে থাকে। তাই দেখা যায় অনেক রোগী থাকার কারনেও ডাক্তার তাড়াহুড়ো করে থাকেন। উন্নত বিশ্বে প্রকৃতভাবে চিকিৎসা শুরুর আগেই চিকিৎসকরা প্রায়ই রোগীকে মনস্তাত্ত্বিক-ভাবে চাঙা করার উদ্যোগ নেন। ব্যবস্থাপত্রে প্রদত্ত ওষুধ সম্পর্কে রোগীকে পর্যাপ্ত ও প্রকৃত তথ্য, পরামর্শ বা উপদেশ প্রদান করা না হলে, যুক্তিহীন ব্যবহারের কারণে রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হবে। প্রেসক্রিপশন প্রদানের পড় একজন ডাক্তার রোগীকে যত বেশি সতর্কতা ও জ্ঞান প্রদান করবেন বুঝিয়ে দিবেন রোগী তত বেশি উপকৃত হবেন। রাজধানীর একটি হাসপাতালে রোগীদের প্রেসক্রিপশনে ঔষধের নামে অনেক অস্পষ্টতা দেখা যায়। আরো কয়েকটি হাসপাতালের সামনে ঘুরে দেখা যায় একই চিত্র। প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধের নাম বা জেনেরিক বোঝার কোন উপায় নেই। ঔষধ বিক্রেতাদের সাথে কথা বললে তারা জানান, কিছু চিকিৎসকদের হাতের লেখা অনেকটা স্পষ্ট তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডাক্তারদের হাতের লেখা একেবারেই বোঝা যায় না। অনেক সময় রোগীকে আবার ওই চিকিৎসকের কাছে বাধ্য হয়ে পাঠাতে হয়। তবে কেউ কেউ কম্পিউটারে লিখে প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন। এতে আমাদের জন্য খুব সুবিধা হয়। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে প্রেসক্রিপশন স্পষ্ট ও বড় আক্ষরে লিখা বা ছাপানো আকারে লিখে রোগীকে দেয়ার জন্য চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দেওয়া হয় উচ্চ আদালত থেকে। ৩০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির নির্দেশনাও দেয় হাইকোর্ট। স্বাস্থ্যসচিব এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কাউন্সিলের রেজিস্টারের প্রতি এ নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই সাথে রোগীদের জন্য স্পষ্টভাবে ব্যবস্থাপত্র লেখায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না ও ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লেখার নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করেন আদালত। তবে পাঁচ বছরেও সেটি বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, অস্পষ্ট হাতের লেখার কারণে ভুল ঔষুধ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে হুট করে হাতের লেখা ভালো করা যায় না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বড় অক্ষরে লিখলে বা কম্পিউটারাইজড করলে সমাধান আসতে পারে। তবে মুল বিষয় হচ্ছে উচ্চ আদালতের নির্দেশনার প্রতিপালন হচ্ছে কতটুকু-তা নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন ভুক্তভোগীরা। প্রেসক্রিপশনে স্বচ্ছতা না আসলে ভবিষ্যতে হুমকির মুখে পড়বে দেশের মানুষ। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন চিকিৎসক বলেন, প্রেসক্রিপশন অবশ্যই স্পষ্ট করে লিখতে হবে। কারণ, এটা রোগীর জীবন-মরণের প্রশ্ন। আশা করি এ বিষয়ে আদালতের রায় হওয়ার পর থেকে চিকিৎসকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। আমরা চাই সহজে পড়া যায় এমন প্রেসক্রিপশন লিখবেন চিকিৎসকরা। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. রশীদণ্ডই মাহবুব বলেন, প্রেসক্রিপশন অবশ্যই স্পষ্ট হওয়া জরুরি। রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেই বলা আছে-চিকিৎসকদের হাতের লেখা স্পষ্ট হতে হবে। কারণ, অস্পষ্ট হাতের লেখার কারণে ভুল ওষুধ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে কারও হাতের লেখা হুট করেই তো আর ভালো করা যায় না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা বড় অক্ষরে লিখলে বা কম্পিউটারাইজড করলে সমাধান আসতে পারে। এ বিষয়ে ওষুধের দোকানে সচেতনতা বৃদ্ধি করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। কারণ, তারাই চিকিৎসকদের প্রেসক্রিপশন পড়ে ওষুধ দেন রোগীকে। তিনি বলেন, ওষুধের দোকানে কর্মরত লোকজন যদি চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ঠিকমতো পড়তে না পারেন তা রোগীর জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।