দেশ থেকে অর্থ পাঁচার দিনদিন বেড়েই চলেছে। শুধু পাঁচারের পথ ও গন্তব্য পরিবর্তন হয়েছে- এমন মন্তব্য অর্থনীতিবিদদের। বিভিন্ন সূত্র বলছে, এখন সবচেয়ে বেশি অর্থ যাচ্ছে দুবাইয়ে। এরপর সিঙ্গাপুরে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও যুক্তরাজ্যও রয়েছে তালিকায়। পাঁচার করা অর্থের গন্তব্য যে সরছে তার প্রমাণ মেলে সর্বশেষ প্রকাশিত সুইস ব্যাংকের প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, সে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে গত এক বছরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি তুলে নিয়েছেন বাংলাদেশী আমানতকারীরা। গত বছর ডিসেম্বরে প্রকাশিত জিএফআইর প্রতিবেদনে বলা হয়, ছয় বছরে দেশ থেকে চার হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাঁচার হয়েছে। প্রতি ডলার ১১২ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় পাঁচ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। গড়ে প্রতি বছর পাঁচার হচ্ছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদদের মতে, অর্থ পাঁচারের কারণ একাধিক। বর্তমানে দেশে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দুর্বল এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা বিরাজমান। ইতোমধ্যে টাকার মান কমে গেছে। এ কারণে বিত্তবানদের অনেকে বিদেশী মুদ্রায় সঞ্চয় রাখতে চাচ্ছেন। অন্য দিকে তাদের নিজের এবং সম্পদের নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা জরুরি। এজন্য তারা বিদেশে অর্থ রাখতে চান। এক কথায়, অর্থনৈতিক দুর্বলতা ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে দেশ থেকে অর্থ পাঁচার বেড়েছে। আসলে বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশ থেকে অর্থ পাঁচার হচ্ছে। দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫-৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। এর কারণ, দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নেই। তাই অর্থ বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ ছাড় দেয়া হয় অর্থ পাঁচারকারীদের। কেউ ৭ শতাংশ কর দিয়ে বিদেশে পাঁচার করা অর্থ ফিরিয়ে এনে বৈধ করতে পারবেন। অথচ দেশে একজন নিয়মিত করদাতা ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কর দেন। সে হিসাবে অর্থ পাঁচারকারীদের প্রণোদনা দেয়া হয়। এই প্রক্রিয়ায় এখন পর্যন্ত কোনো টাকা ফেরত আসেনি। তাই সুইস ব্যাংকের অর্থের গন্তব্য দেশের স্বার্থে জানা দরকার। সেগুলো পাঁচার রোধ এবং পাঁচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনতে দেশের আইন যথেষ্ট। কিন্তু এসব আইন কার্যকরে রাজনৈতিক সদিচ্ছা নেই বলে মনে হয়। লক্ষণীয়, অর্থ পাঁচারকারীরা থাকছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। অর্থ পাঁচারকারী বলে অভিযোগ আছে এমন শতাধিক ব্যক্তির নাম গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা উল্টো রাজনৈতিক সুবিধা দেয়া হয়েছে। বিশ্বে দেড় কোটির মতো প্রবাসী বাংলাদেশী আছেন। তাদের অনেকে দেশে অর্থ পাঠান হুন্ডি করে। হুন্ডির ব্যবস্থাপকরা নিজস্ব অ্যাকাউন্টে অর্থ জমা করে সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশে রেমিট্যান্স গ্রহীতাদের পৌঁছে দিচ্ছেন। এই অর্থ দেশের রেমিট্যান্স আয়ে যোগ হচ্ছে না। এ জন্য অর্থ কারা পাঁচার করছেন, সবার আগে তা চিহ্নিত করতে হবে। সরকারি সংস্থাগুলোকে সক্রিয় করতে হবে। একবার বিদেশে টাকা গেলে তা ফেরত আনা খুব কঠিন। কালো টাকার মালিকরা দেশে অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশে রাখতে নিরাপদ বোধ করেন না। তাই পাঁচার রোধ করতে হলে দুর্নীতি কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। তথ্য-উপাত্ত কোথায় কী আছে- এগুলো ভালোভাবে সংগ্রহ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে অর্থ পাঁচার নিয়ে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুর্নীতি দমন কমিশন, সিআইডি এবং ইমিগ্রেশনের কাছে যে তথ্য আছে তা কাজে লাগাতে হবে।