ভুক্তভোগীকে এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে জামিন পেয়েছেন ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত শিক্ষক মো. আবদুর রহিম (৪৬)। দণ্ডিত আবদুর রহিম রাঙামাটির লংগদু উপজেলার করল্যাছড়ি আর এস উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। জামিন আদেশের পাশাপাশি দুই মাসের মধ্যে ভুক্তভোগীকে ওই এক একর জমি হস্তান্তর করতে বলেছেন হাইকোর্ট। তিন লাখ টাকা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে রসিদ আদালতে দেখানোর পর স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত ওই প্রধান শিক্ষকের তিন মাসের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। পাশাপাশি এ বিষয়ে আদালতের নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটলে আদেশ যাতে পুনর্বিবেচনা করা যায় সেজন্য বিষয়টি ১৫ দিন পর্যবেক্ষণের কথা বলেন আদালত। এরপর বিষয়টি আগামী ১৫ জুলাই আদালতে উঠবে বলে জানান রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী। সাজাপ্রাপ্ত আসামি প্রধান শিক্ষক আবদুর রহিমের আবেদনের শুনানি নিয়ে গত ১ জুন হাইকোর্টের বিচারপতি এস এম কুদ্দুস জামান ও বিচারপতি শাহেদ নূর উদ্দিনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই আদেশ দেন। মামলায় আদালতে আসামিপক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ রেজাউল করিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী। গত ১৫ জুন মামলাটি পুনরায় কার্যতালিকায় আসে। এরপর অধস্তন আদালতের প্রক্রিয়া শেষে গত ২১ জুন আসামি আবদুর রহিম রাঙামাটির কারাগার থেকে মুক্তি পান। সম্প্রতি এ আদেশের লিখিত অনুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বলেন, আদালত এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে আসামিকে (আব্দুর রহিম) জামিন দিয়েছেন। এখন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওই জমি ভুক্তভোগীর পরিবারের অনুকূলে হস্তান্তর না করলে আমরা আসামির জামিন বাতিল চেয়ে আবেদন করবো। হাইকোর্টের লিখিত আদেশে দুই পক্ষের জামিন শুনানির প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, আপিলকারীর (আব্দুর রহিম) আইনজীবী মোহাম্মদ রেজাউল করিম দাবি করেছেন যে, আপিলকারী (আব্দুর রহিম) এরইমধ্যে মামলার ভুক্তভোগীকে বিয়ে করেছেন। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এবং তার মায়ের একটি হলফনামা আদালতে দাখিল করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী রেজাউল করিম। এতে বলা হয়েছে, ভুক্তভোগী আসামিকে বিয়ে করেছেন এবং তিনি (ভিকটিম) যেকোনো শর্তে আসামির জামিন চান। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনিবিক বিবেচনায় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি আদালতকে বলেন, ভুক্তভোগী ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং তার মা একজন দরিদ্র নারী। এ বিয়ের কোনো নিশ্চয়তা নেই এবং জামিন পাওয়ার পর ভুক্তভোগীকে আসামির বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে। এজন্য ভুক্তভোগীর ভবিষ্যতের জন্য কিছু আর্থিক নিরাপত্তার জন্য আবেদনকারীকে (আসামি) বলা যেতে পারে। এ পর্যায়ে বিষয়টির ওপর শুনানি স্থগিত রাখা হয়। পরে আসামিপক্ষের আইনজীবী আদালতে একটি সম্পূরক হলফনামা দাখিল করেন। যাতে বলা হয়, জামিন পাওয়ার পর দুই মাসের মধ্যে আপিলকারী (আসামি) নিবন্ধিত দলিলের মাধ্যমে ভিকটিমের অনুকূলে এক একর জমি হস্তান্তর করবেন। যদি তিনি তা পালন করতে ব্যর্থ হন তবে তিনি আর জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করবেন না। আদালত আদেশে বলেন, মামলার উপর্যুক্ত তথ্য ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষের আইনজীবীদের দাখিল করা অঙ্গীকারনামার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আবদুর রহিমকে তিন মাসের জন্য জামিন দিচ্ছি এই শর্তে যে, আপিলকারী (আব্দুর রহিম) উপর্যুক্ত জামিনের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে উপরে বর্ণিত শর্ত অনুযায়ী (জমি হস্তান্তর সম্পন্ন করে) একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেবেন। আপিলকারী (আসামি) উপর্যুক্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করতে ব্যর্থ হলে তার জামিনের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য কোনো আবেদন গ্রহণ করা হবে না। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৯ নভেম্বর আবদুর রহিমকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেন রাঙামাটির নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ ই এম ইসমাইল হোসেন। একই সঙ্গে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন আসামি আবদুর রহিম। পাশাপাশি তিনি জামিন চেয়েও আবেদন করেন। গত ৩০ মার্চ এ বিষয়ে হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়। তিন মাসের মধ্যে ১০ লাখ টাকা আদায় করে ভুক্তভোগী ছাত্রীকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়ার নির্দেশও দেন আদালত। রায়ে বিচারক তার পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘ছাত্রীকে ধর্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকতার মহান পেশাকে কলঙ্কিত করেছেন আসামি’। এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন অভিযুক্ত আবদুর রহিম। সেসময় তিনি জানান, ওই শিক্ষার্থীকে বিয়ে করেছেন, তাই যে কোনো শর্তে জামিন চান তিনি। ঘটনা এখানেই থেমে থাকেনি। রাষ্ট্রপক্ষও আদালতকে সাফ জানিয়ে দেন, এ ধরনের বিয়ের কোনো ভিত্তি নেই। আর পুরো বিষয়টি জেনে আসতে রাষ্ট্রপক্ষকে নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। পরে রাষ্ট্রপক্ষ এক একর জমি ভুক্তভোগীর নামে লিখে দেওয়ার শর্তে জামিন দেওয়ার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করেন। সব শুনে হাইকোর্ট এক একর জমি লিখে দেওয়ার শর্তে জামিন দেন শিক্ষক আবদুর রহিমকে। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বলেন, আদালত নির্দেশ দেন যে তাদের জামানত হিসেবে একটা কিছু দিতে হবে। তার পরিপ্রেক্ষিতে আসামিপক্ষ থেকে নগদ তিন লাখ টাকা ভুক্তভোগী নারীর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা দিয়ে রশিদ আদালতে দাখিলের মাধ্যমে জামিন পান শিক্ষক আবদুর রহিম। হাইকোর্টের বরাত দিয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী জানান, যদি ভুক্তভোগীর সঙ্গে কোনো অন্যায় আচরণ করা হয়, তবে সঙ্গে সঙ্গে জামিন বাতিল হবে। সুজিত চ্যাটার্জি বাপ্পী বলেন, যেহেতু একটি মেয়ের এবং তার পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে এবং রাঙ্গামাটির আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আমরা উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হইনি। এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি ভুক্তভোগীর পরিবার। মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ থেকে জানা গেছে, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর সকালে ওই ছাত্রী ছাগল খুঁজতে বের হয়। মো. আবদুল রহিম তখন তাকে ডেকে বিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে ধর্ষণ করেন। এ ঘটনায় মামলা না করতে হুমকি দেন আবদুর রহিম। এর ৯ দিন পর একই বছরের ৫ অক্টোবর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে লংগদু থানায় ধর্ষণের মামলা করে ভিকটিমের পরিবার।