গাজীপুরের টঙ্গীতে শ্রমিক নেতা শহীদুল হত্যার সাথে জড়িত প্রকৃত খুনিদের শাস্তি চাইলেন নিহতের স্ত্রী কাজলী আক্তার। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ‘আমি একজন ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী, কেমোথেরাপি দিতে দিতে আমার জীবন শেষ। এদিকে আমার স্বামীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মেরে ফেলা হলো; দুই অবুঝ সন্তানকে নিয়ে আমি কোথায় যাবো। আমার ক্যান্সার, আমি তো আধমরা। আমার স্বামীকে মেরে ফেলল অথচ পুলিশ, কারখানা মালিকপক্ষ কেউ আমার খোঁজ নেয়নি। আমার স্বামীর হত্যার সাথে যারা জড়িত আমি তাদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাই প্রশাসনের কাছে। নিরপরাধ কেউ যেন এ ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত না হয়। স্বামী হারিয়ে অর্থনৈতিক ও মানসিকভাবে চরম কষ্টের জীবন পার করছি। আমার স্বামী কোন হার্টের রোগী ছিলেন না। কেউ যদি বলে থাকে তিনি হার্ট এ্যাটাকে মারা গেছেন তাহলে আমি মেনে নেব না। ওই কারখানায় থাকা অবস্থায়ও আমার স্বামী আমার সাথে কথা বলেছে। আমার ধারণা কারখানা কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কাউকে না কাউকে দিয়ে তাকে মেরেছে। তবে জায়গার সাবেক মালিক কামরুজ্জামান সাহেব এঘটনার সাথে জড়িত কিনা আমি জানি না। আমার কথা হলো যারা প্রকৃত খুনি তাদের ফাঁসি চাই; অন্য কেউকে যেন না জড়ানো হয়।’
এদিকে মামলার তদন্ত পশ্চিম থানা থেকে শিল্প পুলিশে ন্যাস্ত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পেয়েই শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য গ্রহণ করেছেন। শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থলের সিসি টিভির ফুটেজও সংগ্রহ করেছেন শিল্প পুলিশের কর্মকর্তারা। পোশাক শ্রমিকদের দুটি সংগঠনের নেতৃত্বের বিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে।
প্রত্যক্ষদর্শী দোকানদার ফারুক, গার্মেন্টশ্রমিক সাব্বির ও পাশের একটি প্রতিষ্ঠানের দারোয়ান আনোয়ার প্রায় অভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন। তারা জানান, বিবদমান দুটি শ্রমিক সংগঠনের নেতারা কথা কাটাকাটি করে রাস্তা দিয়ে উত্তরে গাছার দিকে যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে ত্রাণ ও দুর্যোগব্যবস্থাপনার গেটের কাছে শ্রমিক নেতা শহীদুল হঠাৎ অসুস্থ হয়ে রাস্তার পাশে বসে পড়েন। এ সময় তার সহকর্মীরা পাশের মাসকোর গেটে গিয়ে দারোয়ানের কাছ থেকে পানি চেয়ে নেন এবং শহীদুলের মাথায় পানি ঢালেন। একপর্যায়ে তারা শহীদুলকে রিকশায় উঠিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। তখন শহীদুল রাস্তায় কোনো মারামারি বা হামলার শিকার হননি বলে এ তিন প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। প্রত্যক্ষদর্শীদের এ বক্তব্যের সাথে প্রাপ্ত সিসি টিভি ফুটেজেরও মিল রয়েছে। হাসপাতালে নিহত শহীদুলের সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকালেও কোনো আঘাতের চিহ্ন পায়নি পুলিশ। আঘাতজনিত কারণে শহীদুলের মৃত্যু হওয়ার কোনো কারণ পাননি লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকও। মামলাটির বর্তমান তদন্তকারী কর্মকর্তা গাজীপুর শিল্প পুলিশ-২ এর পরিদর্শক মো. ওসমান আলী জানান, চিকিৎসকরা শহীদুলের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অনুসন্ধানের জন্য ভিসেরার নমুনা ঢাকায় ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে পাঠিয়েছেন। তিনি আরো জানান, শিল্প পুলিশ সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে মামলাটি তদন্ত করছে। ইতোমধ্যে মামলার একজন আসামীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বাকি আসামীদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।
উল্লেখ্য, গত ২৫ জুন গাজীপুর মহানগরের টঙ্গী সাতাইশ এলাকায় প্রিন্স জ্যাকার্ড সোয়েটার লিমিটেড নামক কারখানায় বকেয়া বেতন আদায় সংক্রান্তে নেতৃত্ব নিয়ে কারখানাটির বাহিরে দুটি শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের মধ্যে বাকবিত-া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় প্রতিপক্ষের আঘাতে শ্রমিক নেতা শহীদুলের মৃত্যু হয় মর্মে অভিযোগ করে বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ- ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশন। এ ঘটনায় সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি কল্পনা আক্তার বাদী হয়ে গত ২৬ জুন টঙ্গী পশ্চিম থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের টঙ্গী পশ্চিম থানা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মাজহারুলসহ ৬ জনকে এজাহার নামীয় আসামি করা হয়। আসামীদের ৫ জনই বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের নেতা। নিহত শহীদুল ইসলাম বাংলাদেশ গার্মেন্টস এ- ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের গাজীপুর জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন।