রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় কারাগারে থাকা দুই আসামির ফাঁসি চলতি মাসেই কার্যকর হতে পারে। এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই সকল আইনি প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। তাই জেল কোড অনুযায়ী অভিযুক্ত দুই আসামিকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হতে পারে চলতি মাসেই। কারাবিধি অনুযায়ী আগামী ২৫ জুলাই থেকে আগামী ১ আগস্টের মধ্যে ফাঁসি কার্যকর করা যাবে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আবেদন নাকচের চিঠি রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে পৌঁছার পরই ফাঁসি কার্যকরের সকল আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। বর্তমানে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে বন্দি থেকে মৃত্যুর জন্য ক্ষণ গণনা করছেন রাবির ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মিয়া মো. মহিউদ্দিন ও নিহত ড. এস তাহেরের বাসার তত্ত্বাবধায়ক জাহাঙ্গীর আলম। ইতোমধ্যেই পরিবারের সদস্যরা দেখা করতে শুরু করেছে।
এই দুই আসামির মৃত্যুদ- কার্যকর প্রশ্নে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার নিজাম উদ্দিন জানান, মৃত্যুদ-প্রাপ্তরা কারাবিধি অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন। সেই আবেদন নাকচ হওয়ার চিঠি ও সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র গত ৫ জুলাই আমাদের কারাগারে পৌঁছেছে। এখন কারাবিধি মেনেই তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে।
এ বিষয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের উপ-মহাপরিদশক (ডিআইজি প্রিজন) কামাল হোসেন বলেন, রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ায় ফাঁসি কার্যকরে আর কোনো আইনি বাধা নেই। এখন জেল কোড অনুযায়ী ফাঁসি কার্যকরের ধাপগুলো এক এক করে বাস্তবায়ন করা হবে। জেল কোডে আদেশপ্রাপ্তির ২১ থেকে ২৮ দিনের মধ্যে মৃত্যুদ- কার্যকরের বিধান রয়েছে। এর আগে দ-িতদের শেষ স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও তাদের সঙ্গে পরিবার এবং স্বজনদের শেষ দেখা করার সুযোগ দেওয়ারও বিধান আছে।
আর এ বিষয়ে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিহা সুলতানা জানান, তারা পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করে ফাঁসির রায় কার্যকরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২ মার্চ এই আসামির ফাঁসি এবং যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত এক আসামির রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন খারিজ করেন সুপ্রিমকোর্ট। নিম্ন আদালতে দু’জনের মৃত্যুদ-ের যে রায় দেওয়া হয়েছিল আপিলে তা বহাল থাকে, আর খারিজ হয় রিভিউ আবেদন। এরপর রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা ছাড়া তাদের আর কোনো পথই খোলা ছিল না। এরপরও দুজনের ফাঁসি কার্যকর স্থগিত চেয়ে হাইকোর্টে গত ৭ মে ফের রিট আবেদন করেন তাদের স্বজনরা। যদিও উত্থাপিত হয়নি মর্মে পরবর্তী সময়ে সে আবেদনও খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।
প্রসজ্ঞত, ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আবাসিক কোয়ার্টার থেকে নিখোঁজ হন অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ। পরদিন বাসাটির পেছনের ম্যানহোল থেকে উদ্ধার করা হয় তার মরদেহ। ওই বাসাটিতে তিনি একাই থাকতেন। আর তার দেখাশোনা করতেন কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর আলম। আর এ ঘটনায় ৩ ফেব্রুয়ারি ড. তাহেরের ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ বাদি হয়ে রাজশাহীর মতিহার থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার পর অধ্যাপক তাহেরের করা পূর্বের একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মহিউদ্দিন ও রাবির ইসলামি ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক তাহের বিভাগের অ্যাকাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু বাস্তব কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মহিউদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। বালিশ চাপায় খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের লাশ বাসার পেছনে নেওয়া হয়। লাশ গুমের জন্য জাহাঙ্গীররের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় বাসার পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে অধ্যাপক তাহেরের লাশ ফেলে দেওয়া হয়।
এ মামলায় ২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দেয় পুলিশ। বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসি ও দু’জনকে খালাস দেন। দ-িত অন্যরা হলেন, জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল ও তার স্ত্রীর ভাই সালাম। তবে বিচারে খালাস পান ছাত্রশিবিরের নেতা সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সি। পরবর্তীতে দ-প্রাপ্তরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। আপিল বিভাগ মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের রায় বহাল রাখলেও নাজমুল ও সালামের রায় কমিয়ে যাবজ্জীবন করেন। কিন্তু তাদের দ- বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাইকোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন।
এদিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. এস তাহের আহমেদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামি একই বিভাগের সহকারি অধ্যাপক মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিনকে চুড়ান্তভাবে বরখাস্ত করে কর্তৃপক্ষ। গত ২৩ মে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম সাক্ষরিত এক আদেশে ২০০৮ সালের ২২ মে থেকে শিক্ষকের পদ থেকে শিক্ষক মহিউদ্দিনকে চুড়ান্তভাবে বরখাস্ত করা হয়।