বিএনপির ভ্যানগার্ড হিসাবে পরিচিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বেহাল দশা উত্তরের জেলা রংপুরে। এ জেলার আহ্বায়ক কমিটি গঠনে ত্যাগী নেতাদের অবমূল্যায়ন, নানান অসঙ্গতি-সমন্বয়হীনতা, সদস্য সচিবের বিরুদ্ধে চুরি সহ ও অর্থ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সিনিয়র-জুনিয়র না মেনে দেয়া হয়েছে পদ-পদবী। এমনকি দীর্ঘদিনের রাজপথের পরিচিত নেতাদেরর বাদ দিয়ে ইউনিয়ন পর্যায়ের কিছু নেতাকে রাখা হয়েছে কমিটিতে। সদস্য সচিবসহ কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে বিস্তর অভিযোগ। এতে রংপুর জেলা সহ বিভিন্ন উপজেলা পর্যায়ে নেতাকর্মীরা চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সম্প্রতি ঘোষিত রংপুর জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণার পর থেকেই চলছে সমালোচনার ঝড়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানাভাবে এই কমিটিতে পদপ্রাপ্ত সদস্য সচিবসহ অনেক নেতৃবৃন্দকে নিয়ে নানান বির্তক দেখা দিয়েছে।
এদিকে রংপুর জেলা সম্প্রতি ঘোষিত ছাত্রদলের কমিটিকে গঠনতন্ত্র পরিপন্থী, অসঙ্গতিপূর্ণ, সমন্বয়হীন ও বিধি বহির্ভূত কমিটি হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির বেশকয়েকজন নেতাকর্মী। তারা বলেন, নব ঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক সহ হাতেগোনা দুইতিনজন বাদে কমিটিতে স্থান পাওয়া অনেক নেতাকর্মীদের তেমন কোনো রাজনৈতিক পরিচয় নেই। দলের জন্য কোন ভূমিকা ছিল না। সাধারণ মানুষজন তো দুরের কথা দলের নেতাকর্মীরাই তাদের চেনেন না। অনেকই বিভিন্ন দল এসেছেন। মাদকসেবী, অছাত্র, চোর সিন্ডিকেটের সদস্য সহ নানান অপরাধের সাথে জড়িত বির্তকিত বেশ কয়েকজন স্থান পাওয়ায় ক্ষোভ বাড়ছে। তাঁদেরকে এসব পদ দেওয়া হলে ছাত্রদলের সংগঠন খাদের কিনারে নিমজ্জিত হবে।
তারা বলেন, পদ পাওয়া জেলার সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মোস্তাফিজার রহমান মিলু সরকার পীরগঞ্জ উপজেলার আহবায়ক। তিনি নিজের উপজলায় দলকে সু-সংগঠিত করতে পারেননি। কমিটি দেয়ার কথা বলে পদ বাণিজ্য, মাদক সেবন সহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বির্তকিত কর্মকান্ডের কারণে তিনি ইতঃপূর্বে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তারও হয়েছিলেন। সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আবতাবুজ্জামান সুজন
ছিলেন হারাগাছ পৌরসভার সদস্য সচিব। তার নিজ পৌরসভায় তিনি দল গোছাতে ব্যর্থ হয়েছে। দলে নিষ্কিয় ছিলেন। একটি পৌরসভার সদস্য সচিব কিভাবে জেলার গুরুত্বপূর্ণ পদে অসীন হয় তা নিয়েও নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
তারা অভিযোগ করে বলেন, জেলা আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে শরীফ নেওয়াজ জোহাকে। তিনি সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। যুগ্ম আহ্বায়ক পদে দায়িত্ব পাওয়া মো: আকাশ ছিলেন সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। এ ছাড়া যাদের যুগ্ম আহ্বায়ক ও সদস্য করা হয়েছে তারা ইতঃপূর্বে জেলা কমিটিতো দুরের কথা উপজেলা কমিটিতেও ছিলেন না। অর্থচ সদ্য বিলুপ্ত কমিটির ২০১ সদস্যের অনেকেই পদ পাননি। স্বেচ্ছাসেবক দল ও শ্রমিক দলের দুই নেতাকেও কমিটিতে পদ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এক পদ নিয়ে দুই-তিনজনের দাবিও উঠেছে।একরাণে তৃণমূলে পর্যায়ে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। ক্ষুদ্ধ নেতাকর্মীরা। তারা বলেন, জেলার মতো গুরুত্বপুর্ণ ইউনিটে যাদের পদ দেয়া হয়েছে তাদের অনেকের নেই রাজনৈতিক পরিচিতি, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান। অথচ এমন কমিটি দেয়ার করাণে কার্যত ছাত্রদলের রংপুর জেলা, পৌর ও থানা ইউনিটগুলোকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা চলছে বলে তারা মনে করেন। তারা অভিযোগ করেন, জেলা বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশে ছাত্রদলকে ধ্বংস করতে এমন কমিটির সুপারিশ করেন। তারা অতিদ্রুত কমিটি বাতিল করে ত্যাগী, রাজপথের পরিক্ষিত ও আওয়ামী সরকারের মামলা-হামলা-নির্যাতনের শিকার এবং কর্মীবান্ধব নেতাদের সম্বনয়ে নতুন করে জেলায় কমিটি গঠনের দাবি জানান।
নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, রংপুর জেলা ছাত্রদলকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখার জন্য এবং সংগঠনকে গতিশীল, বেগবান ও আন্দোলন মূখর করে গড়ে তুলতে নবগঠিত নামসর্বস্ব আহ্বায়ক কমিটি বাতিল করতে হবে। নতুন করে একটি সুন্দর পরিচ্ছন্ন ও সকলের নিকট গ্রহণযোগ্য কমিটি গঠন করতে হবে। এজন্য ছাত্রদলের অভিভাবক বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সহ ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নিকট আহ্বান জানান।
পীরগাছা উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক লোকমান হোসেন বলেন, জেলা কমিটি গঠন হলো অথচ উপজেলার আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবকে কোন পদ দেয়া হলো না। অথচ ইউনিয়ন পর্যায়ের কর্মীদের পদ দেয়া হয়েছে। পৌরসভার আহবায়ককে মূল্যায়ন না করে সদস্য সচিবকে জেলার সদস্য সচিব করা হয়েছে। যারা বিরুদ্ধে নানান অভিযোগ রয়েছে। এর মাধ্যমে সদ্য ঘোষিত জেলার আহ্বায়ক কমিটি একটি সমন্বয়হীন, অগ্রহণযোগ্য, নামসর্বস্ব মৃতপ্রায় কমিটিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান কমিটিতে ত্যাগি অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এবং রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতাদেরকে বাদ দেওয়া হয়েছে। অতীতে ছাত্রদলের আন্দোলন সংগ্রামের সাথে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরকে বাদ দিয়ে অপরিচিত মূর্খ ও অদক্ষদের নিয়ে কমিটি আমার ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করছি। সেই সাথে তৃণমূলের মতামতের ভিত্তিতে কমিটি বাতিল পূর্বক নতুন কমিটির দাবি জানাচ্ছি।
জেলা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সভাপতি সজিব মজুমদার বলেন, রংপুর জেলা ছাত্রদলের কমিটিতে ত্যাগী ও রাজপথের সক্রিয় নেতাদের বাদ দিয়ে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তা প্রত্যাখান করছি। এই কমিটি দিয়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ঘোষিত এক দফা আন্দোলন রাজপথে সফল করা সম্ভব বলে না বলে তিনি জানান।
রংপুর জেলা ছাত্রদলের সদ্য বিলুপ্ত কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মিজানুর রহমান মিজান ও আইন বিষয়ক সম্পাদক সবুক্তগীন আহমেদ নিরব বলেন, রংপুর জেলা ছাত্রদলের নবগঠিত আহ্বায়ক কমিটিতে সংগঠনের জন্য নিবেদিত প্রাণ, যোগ্য, ত্যাগি ও আন্দোলনরত নেতাদের মূল্যায়ন করা হয় নাই। যোগ্যতা সম্পন্ন ত্যাগি ও মাঠ পর্যায়ের আন্দোলন সম্পৃক্ত নেতৃবৃন্দকে বাদ দিয়ে ইতোপূর্বে যারা কোন ভাবেই আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত কিংবা সংগঠনের সাথে জড়িত ছিল না তাদের পদ দেয়া হয়েছে। এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে যারা উপজেলা নেতৃবৃন্দের অধীনে রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন, উপজেলা নেতৃবৃন্দকে বাদ দিয়ে ইউনিয়ন পর্যায় থেকে নিয়ে এসে একেবারেই অচেনা ও অপরিচিত মুখকে জেলার গুরত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে। যাদের না আছে কোন রাজনৈতিক পরিচিতি, অভিজ্ঞতা। না রয়েছে ব্যক্তিগত, সামাজিক অবস্থান।
হারাগাছ পৌরসভা ছাত্রদলের আহ্বায়ক মো: ফরিদ ও যুগ্ম আহ্বায়ক বাঁধন মিয়া বলেন, জেলা কমিটির সদস্য সচিব হিসাবে দায়িত্ব পাওয়া আবতাবুজ্জামান সুজন হারাগাছ পৌরসভা কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন। তিনি দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। দলীয় কর্মসূচী, আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন লোকচক্ষুর আড়ালে। তাকে জেলার গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হলো তা আমাদের বোধগম্য নয়।
কাউনিয়া উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম বলেন, জেলা ছাত্রদলকে যারা সু-সংগঠিত করেছেন, দায়িত্বে ছিলেন তাদের পদে রাখা হয়নি। ত্যাগী ও রাজপথের পরিচিত মুখদের পরিকল্পিত ভাবে বাদ দেয়া হয়েছে।
তারাগঞ্জ উপজেলা ছাত্রদলের সদস্য সচিব আকতারুজ্জামান শুভ বলেন, সদস্য সচিব সহ যাদের কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে তারা রংপুর বিএনপি তো দুরের কথা ছাত্রদলের ইতিহাস সর্ম্পকে বলতে পারবেন না। কাউন্সিলের আয়োজন না করে কিংবা পূর্বের কমিটির কাউকে না জানিয়ে আকস্মিক জেলা ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র পরিপন্থী ও বিধি বহির্ভূত কমিটি ঘোষিত হওয়ায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। একারণে আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রামসহ দলের অনেক নিবেদিত নেতাকর্মী অভিমানে নিস্কিয় হয়ে পড়েছেন।
জেলা কমিটির সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব আসিফ বলেন, ইউনিয়নের নেতারা জেলা কমিটিতে পদ পায়। জেলায় নেতৃত্ব দিয়েছেন যারা। তাদের রাখা হয়নি। অথচ যারা ইউনিয়ন ও উপজেলায় অনেক নেতাকর্মী তৈরি করেছেন তারা পদ পান না। এখন আমরা কোথায় গিয়ে রাজনীতি করবো। যাদের জেলা কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে সেই কমিটির সদস্য সচিবসহ অনেককেই রাজপথে সংক্রিয় ছিলেন না। নেই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। কোন শক্তির বলে তাদের পদে রাখা হয়েছে তা বোধগম্য নয়।
জেলা কমিটির সাবেক সহ-সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান ও মিঠাপুকুর উপজেলা সদস্য সচিব শামসুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, আমরা যারা দলকে সু-সংগঠিত করতে কাজ করেছি তাদের বাদ দিয়ে জুনিয়র ছেলেদের নেতা বানানো হয়েছে। যাদের নেই কোন রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, ব্যক্তিগত ও সামাজিক অবস্থান। আমাদের কমিটিতে রাখা হয়নি অথচ আমার ইউনিটের কলেজ শাখার যুগ্ম আহবায়কে জেলার সদস্য করা হয়েছে। এ ছাড়া এমন অনেককে পদ দেয়া হয়েছে যাদের পরিচয় এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। কিছু পদে একাধিক জন দাবি করেন।
এব্যাপারে সদস্য সচিব আবাতাবুজ্জামান সুজনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি। একারণে তার কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সদ্য ঘোষিত রংপুর জেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক শরীফ নেওয়াজ জোহার সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বর্তমান কমিটিতে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে। ত্যাগী ও রাজপথের ত্যাগীরা স্থান পাননি। বিগত কমিটির অধিকাংশই নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা হয়নি। ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের আহ্বায়ক কমিটিতে পদে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে অনেক নেতাকর্মীর মনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। তৃণমূল নেতাকর্মীরা অসন্তোষ। বিষয়টিগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সম্পাদক সাথে কথা হয়েছে। তারা যেভাবে পরামর্শ দেবে। সেই মোতাবেক কাজ করা হবে।
উল্লেখ্য, গত ৮ জুন শরীফ নেওয়াজ জোহাকে আহ্বায়ক ও আবতাবুজ্জামান সুজনকে সদস্য সচিব করে রংপুর জেলা ছাত্রদলের ২১ সদস্য বিশিষ্ট আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় কমিটি।