চীনে একদিকে কর্মস্থলে অমানুষিক শ্রম, অন্যদিকে চাকরির বাজারের নিদারুণ হাল। এই দুই কারণে দেশটির তরুণসমাজ অভিনব জীবন বেছে নিচ্ছে। ২৯ বছর বয়সী জুলির সারাটা দিন কাটে বাসন ধুয়ে, বাবা-মায়ের জন্য রান্না এবং সংসারের আরো নানা কাজ করে। জুলির বাবা-মা তাকে প্রতিদিনের হাতখরচাটা জোগান। তারা জুলিকে মাসে দুই হাজার ইউয়ান (২৮০ ডলার) বেতন দিতে চেয়েছিলেন। জুলি নেননি। জুলি এই মুহূর্তে চাইছেন প্রতিদিন ১৬ ঘণ্টা অমানুষিক পরিশ্রমের হাত থেকে মুক্তি। তিনি বলেন, ‘আমি ছিলাম আদতে একটা লাশ, যেটা শুধু হেঁটেচলে বেড়াত।’কাজের চাপে নাজেহাল, অতিরিক্ত খাটুনিতে ক্লান্ত জুলি এপ্রিল মাসে তার চাকরিবাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে গেছেন বাবা-মায়ের কাছে ‘পূর্ণকালীন সন্তান’ হিসেবে ঘরে থাকতে। বেইজিংয়ে তিনি কম্পিউটার গেম তৈরির কাজ করতেন। জুলির মতো তরুণ-তরুণীর সংখ্যা চীনে ক্রমশ বাড়ছে, যারা নিজেদের নাম দিয়েছে 'পূর্ণকালীন সন্তান'। এরা বাবা-মায়ের আরামের সংসারে ফিরে যেতে চাইছে- হয় অমানুষিক পরিশ্রমের পর কিছুদিন আরাম-আয়েশ করে দিন কাটাতে, নয়তো বাজারে চাকরি খুঁজে হন্যে হয়ে কিছুই না জোটাতে পেরে। তথাকথিত এই ‘পূর্ণকালীন সন্তানদের’ অনেকেই বলেছেন, তারা দীর্ঘমেয়াদে ঘরে বসে থাকতে চান না, এটা নিতান্তই সাময়িক। তাদের জন্য এটা শুধুই আরাম করার জন্য কিছুটা সময় বেছে নেওয়া, সেই সময় সামনের কর্মপরিকল্পনা নিয়ে ভাবা এবং ভালো চাকরি খোঁজা। কিন্তু এটা বলা যত সহজ, কাজটা তত সহজ নয়। জুলি গত দুই সপ্তাহে এ পর্যন্ত চাকরির সন্ধানে ৪০টির বেশি আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন। ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছেন মাত্র দুই জায়গা থেকে। তিনি বলেন, ‘চাকরি ছাড়ার আগে কাজ পাওয়া ছিল কঠিন, এখন চাকরি ছাড়ার পর তা আরো কঠিন হয়ে উঠেছে।’ মে মাসে প্রকাশিত সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশটিতে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের বেশি কর্মহীন। ২০১৮ সালে কর্তৃপক্ষ এই তথ্য প্রকাশ শুরু করার পর থেকে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেকারত্বের হার বর্তমানে সবচেয়ে বেশি। গ্রামীণ এলাকায় চাকরির বাজারের চিত্র এই পরিসংখ্যানের অন্তর্ভুক্ত নয়। চীনে তরুণ প্রজন্মকে সব সময় বলা হয়েছে যে সাফল্য পেতে হলে, জীবনে জিততে হলে লেখাপড়ার জন্য অনেক খাটতে হবে, কঠিন পরিশ্রম করে ভালো ডিগ্রি পেতে হবে। এখন সেই প্রজন্ম মনে করছে, জীবনযুদ্ধে তারা পরাজিত। তারা একটা জাঁতাকলে আটকা পড়েছে। চীনে কর্মজীবন ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে ভারসাম্য রাখার ব্যাপারটা এতটাই কঠিন যে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা শ্রম দিয়ে দম ফুরিয়ে যাওয়া প্রাপ্তবয়স্করাই বাবা-মায়ের ‘পূর্ণকালীন সন্তান’ হয়ে উঠছেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। চীনে কর্মসংস্কৃতিকে প্রায়ই ব্যাখ্যা করা হয় প্রচলিত ‘৯৯৬’ নামে। অর্থাৎ সেখানে সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয় সপ্তাহে ছয় দিন। জ্যাক ঝেং সম্প্রতি চীনের বিশাল প্রযুক্তি কম্পানি টেনসেন্ট থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। তিনি বলছিলেন, তাকে প্রতিদিন কাজের সময়ের বাইরে কাজসংক্রান্ত প্রায় ৭০০০ টেক্সট মেসেজের উত্তর দিতে হতো। ৩২ বছর বয়সী এই প্রযুক্তিকর্মী বলছেন, এটা ‘অদৃশ্য একটা ওভারটাইম।’ কারণ আপনার কাছে কাজ চাওয়া হচ্ছে, কিন্তু তার বিনিময়ে কোনো অর্থ দেওয়া হচ্ছে না। অবশেষে তিনি কাজ ছাড়তে বাধ্য হন, কারণ অতিরিক্ত পরিশ্রমের কারণে তিনি ফলিকিউলাইটিস রোগের শিকার হন। এটা এক ধরনের চর্মরোগ। মানসিক চাপ থেকে এই রোগে চুলের গোড়ায় প্রদাহ সৃষ্টি হয়। তবে ঝেং এরপর একটা ভালো চাকরি পেয়েছেন, যদিও তিনি বলছেন, তার আশপাশে অন্যরা তার মতো ভাগ্যবান হননি। অনেকেই মনে করেন, তারা তথাকথিত ৩৫-এর অভিশাপের শিকার। চীনের মানুষ ব্যাপকভাবে বিশ্বাস করে, দেশটির চাকরিদাতারা ৩৫-এর বেশি বয়সীদের কাজ দিতে চান না। তারা চান তরুণ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের, কারণ তাদের ওপর খরচ কম, তাদের বেতন দিতে হয় কম। তিরিশের মধ্য কোঠায় যাদের বয়স, তাদের জন্য এটা বিরাট একটা চ্যালেঞ্জ। একদিকে বেশি বয়সের কারণে বৈষম্য, অন্যদিকে চাকরির বাজারে মন্দা। তাদের মাথার ওপর হয় রয়েছে বাড়ি কেনার জন্য নেওয়া বন্ধকের বোঝা, নয়তো এই বয়সে কেউ কেউ বিয়ে করে সংসার পাতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়াদের মধ্যেও হতাশা কম নেই। তারাও এতটাই হতাশ যে অনেকে ইচ্ছে করে পরীক্ষায় ফেল করছেন, যাতে স্নাতক হওয়াটা পিছিয়ে দেওয়া যায়। গত কয়েক সপ্তাহে চীনের সামাজিক মাধ্যম ছেয়ে গেছে গ্র্যাজুয়েট হওয়া শিক্ষার্থীদের ভিন্নধর্মী নানা ছবিতে। ছবিতে সাফল্যে উল্লাস প্রকাশের বদলে সদ্য গ্র্যাজুয়েটদের হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে। কিছু ছবিতে দেখা যাচ্ছে, স্নাতক উপাধি নেওয়ার বিশেষ গাউন পরে আর গ্র্যাজুয়েট টুপি দিয়ে মুখ ঢেকে তারা মাটিতে শুয়ে রয়েছেন। কোনো কোনো সদ্য স্নাতকরা ছবি পোস্ট করেছেন, যেখানে তাদের হাতে সার্টিফিকেট ধরা আছে আবর্জনার বিনের ঠিক ওপরে, যেন সেটা এখুনি ময়লার ঝুড়িতে ফেলা হবে। একসময় চীনে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন বড়লোকের ছেলেমেয়েরা। কিন্তু ২০১২ থেকে ২০২২-এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার ৩০ শতাংশ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯.৬ শতাংশে। কারণ প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে উন্নত সুযোগ পাওয়ার জন্য ডিগ্রি অর্জনকে সেই জগতে পা রাখার একটা গুরুত্বপূর্ণ সিঁড়ি বলে মনে করতে শুরু করেন বহু তরুণ। কিন্তু চাকরির বাজার সঙ্কুচিত হয়ে পড়ায় তাদের সেই আকাক্সক্ষা রূপ নেয় চরম হতাশায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরো এক কোটি ১৬ লাখ নতুন স্নাতক এখন চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতায় নামায় অবস্থা আরো খারাপ হয়ে উঠবে। কভিডের পর চীনে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ার অপ্রত্যাশিত শ্লথগতি বেকারত্ব এত বাড়ার প্রধান কারণ বলে মনে করেন ব্রুস প্যাং, যিনি জোন্স ল্যাং লাসালে নাামে একটি সংস্থায় বৃহত্তর চীন বিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ। কোনো কোনো কর্মদাতা নতুন স্নাতকদের চাকরি দিতে অনাগ্রহী, যারা ক্রমাগত কভিড লকডাউনের কারণে অতীতের গ্র্যাজুয়েটদের তুলনায় কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন খুবই কম। কর্মদাতারা এই চাকরি প্রত্যাশীদের দেখছেন শুধু ডিগ্রির কাগজধারী হিসেবে- বলছেন প্যাং। চীনের পেশাদার তরুণরা যেসব শিল্প খাতে কাজ করতে বেশি উৎসাহী, সেই খাতগুলোর ওপর চীনা কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি দমননীতি চালানোয় তার একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে চাকরির বাজারে। বড় বড় প্রযুক্তি কম্পানিগুলোর ওপর ব্যাপক কড়াকড়ি আরোপ, প্রশিক্ষণ খাতের ওপর বিধি-নিষেধ এবং বেসরকারি শিক্ষা খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ওপর নিষেধাজ্ঞা- এইসব কিছুর কারণে অনেক চাকরি এখন বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে। চীনের সরকার এসব সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল, কিন্তু তারা এটাকে বড় কোনো সমস্যা হিসেবে দেখাতে চায় না। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র পিপলস ডেইলি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় মে মাসে চীনা নেতা শি জিনপিংকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি তরুণ প্রজন্মকে তিতা ওষুধ গেলার আহ্বান জানিয়েছেন। ম্যান্ডারিন ভাষায় যার অর্থ কষ্ট সহ্য করো। ইতোমধ্যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংবাদমাধ্যম বেকারত্বকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে। রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক পত্রিকা ইকোনমিক ডেইলির এক সম্পাদকীয়তে গত সপ্তাহে নতুন একটি পরিভাষা ব্যবহার করা হয়েছে ‘ধীরেসুস্থে কর্মসংস্থান’। লেখা হয়েছে, কিছু চীনা তরুণ যদিও সত্যিই বেকার, কিন্তু বাকিদের অনেকেই সক্রিয়ভাবে আস্তে-ধীরে সময় নিয়ে কাজে যোগ দিতে চাইছে। এই পরিভাষার উৎস কোথা থেকে তা স্পষ্ট নয়, তবে চায়না ইয়ুথ ডেইলিতে ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক নিবন্ধে লেখা হয় যে, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা এ রকম স্নাতকের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে, যারা পাস করেই চাকরি খুঁজছে না, বরং তারা এজন্য সময় নিচ্ছে। অনেকে পাস করার পর বেড়াতে যাচ্ছে বা অল্প সময়ের জন্য শিক্ষকতার কাজ নিচ্ছে। চীনা জনগণকে বলা হয় এটাই হলো স্লো এমপ্লয়মেন্ট বা ধীরেসুস্থে কর্মসংস্থানের ধারা। এখন তাদেরও এই সংজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যারা চাকরি পায়নি বা লেখাপড়া আরো চালিয়ে যেতে চাইছে কিংবা নতুন কিছু শিখছে বা পাস করে এক বছরের বিরতি নিচ্ছে। চাকরির বাজার যত খারাপই হোক না কেন, পত্রিকায় তরুণদের পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে যে তারা যেন কঠিন শ্রমে উদ্যোগী হয় এবং কিছু একটা করে। আর সেটা করলে তাদের বেকার থাকা নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হবে না। চীনে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সীদের প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজনের বেশি কর্মহীন। তবে বর্তমানে চাকরির বাজারের যে দুরবস্থা, তাতে আস্তে-ধীরে কাজ নেওয়ার নতুন এই পরিভাষা এবং পরামর্শ কোনোটাই মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছে না।
সূত্র : বিবিসি