দৃষ্টিনন্দন কারুকার্যে সমৃদ্ধ বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ। বাগেরহাটের জেলার নামের সাথে “ষাটগুম্বজ“ মসজিদটি নানকরণ ও সকল প্রকার ঐতিহ্য মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে। এই মসজিদটি বর্তমান সময়ে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। এই মসজিদের গম্বুজ প্রকৃতপক্ষে আছে ৮১টি। নাম যাই হোক সম্প্রকিক কালে কয়েক শতাব্দী ধরে এই মসজিদটি এ অঞ্চলসহ দেশ-বিদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে। প্রচলিত অর্থে এই মসজিদটির কোন ছাঁদ নেই। অর্ধডিম্বাকার ও আয়তাকার গম্বুজ গুলিই হচ্ছে এ মসজিদটির ছাদ। এজন্যই মসজিদটি ছাঁদ গম্বুজ মসজিদ হিসেবে একসময়ে পরিচিতি লাভ করে। কালের বিবর্তনে বিকৃত কথ্যরুপে পরিবর্তন হয়ে যা পরবর্তীতে ষাটগম্বুজ নামকরণ হয়েছে। তবে এ অঞ্চলের ঐতিহাসিক মুসলিম নিদর্শন এ মসজিদটির নামকরণ নিয়ে নানা ধরনের কথা এলাকায় প্রচলিত রয়েছে। মসজিদটির সামনে অবস্থিত কয়েকটা প্রটেকশন দেওয়াল মানুষকে আজও স্মরণ করিয়ে দেয় হযরত খানজাহান আলী (রহঃ) এর হাজার হাজার সঙ্গী নিয়ে বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল পাড়ি দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের এই বাগেরহাট এলাকায় স্থায়ী অবস্থান গড়ে তোলা ও তাঁর কর্মময় জীবনের ইতিহাস। এ মসজিদটি দেখতে দেশ বিদেশের হাজারো মানুষ দর্শনার্থী হিসেবে বর্তমানে ভিড় জমায়। প্রতিনিয়তই এখানে দিন দিন পর্যটকদের আনাগোনা বেড়েই চলেছে।
বাগেরহাট শহরের সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে ষাটগম্বুজ মসজিদটির অবস্থান। সুলতানী আমলের আকর্ষণীয় স্থাপত্যশৈলীর এই মসজিদ বাগেরহাট শহরের অন্যতম আকর্ষণ। ষাটগম্বুজ ছাড়াও অসংখ্য মসজিদ, দীঘি ও স্থাপনা নির্মাণ করেছিলেন হযরত খানজাহান (রহঃ)। ঐতিহাসিকদের ধারণা-বিলুপ্ত প্রায় প্রাচীন খলিফাতাবাদ নগরই আজকের বাগেরহাট। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত বিশ্ব বিখ্যাত ফোবর্স ম্যাগাজিন হারিয়ে যাওয়া যে ১৫টি শহরের তালিকা করেছে তাতে রয়েছে এই শহরের নাম। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসাবে ষাট গম্বুজ মসজিদসহ খানজাহানের স্থাপত্যগুলোকে তালিকাভুক্ত করেছে।
চৌদ্দশত খ্রীষ্টাব্দের গোড়ার দিকে সম্রাট ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনামলে সুদূর দিল্লীর জৌনপুর থেকে ইসলাম প্রচারের লক্ষ্যে এতদাঞ্চলে আগমন ঘটে মহান সাধক হযরত খানজাহান (রহঃ) এর। এ সময় ৬০ হাজার ভক্ত ও মুসলিম সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী তাঁর সাথে ছিল বলে এলাকায় কথিত রয়েছে। দীর্ঘ এ পথ যাত্রায় তিনি প্রথমে রাজশাহীর সোনা মসজিদ এলাকায় আসেন। পরে সেখান থেকে ফরিদপুর, যশোরের বারো বাজার, খুলনার বাশুয়ারী, ফুলতলা ও দিঘলিয়া হয়ে বাগেরহাট এসে তাবু স্থাপন করেন। কথিত আছে তিনি দিঘলিয়ার বারাকপুর হয়ে ভৈরব নদের তীর দিয়ে লম্বালম্বি পাড়ি দিয়ে পূর্বের দেবনগরে এসে অবস্থান নেন। সেখান থেকে তিনি সঙ্গীয় সেনাদের ব্রহ্মগাতীও পানিগাতী গ্রামের দক্ষিণে মাঝামাঝি জায়গায় একটা দীঘি খননের নির্দেশ দেন। লম্বালম্বি নদী তীর পাড়ি দেওয়ার কারণে দীঘল থেকে দিঘলিয়া নামকরণ করা হয়েছে। অপর দিকে দেবনগর থেকে দীঘি খননের মরমায়েশ জারী করার কারণে দেবনগর নাম পরিবর্তন করে নামকরণ করা হয় ফরমাইশখানা এবং তাঁর নির্দেশনায় খননকৃত দীঘিই বর্তমানে সিমান্ত দীঘি নামে পরিচিত। যা কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাগেরহাট এসে বন-জঙ্গল পরিস্কার করে ২০ বর্গমাইলের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যার নাম দেন খলিফাতাবাদ। তিনি খলিফাতাবাদ রাজ্যের প্রজা সাধারণের সুবিধার জন্য প্রথমে জাঙ্গাল বা রাস্তা তৈরী করেন। দক্ষিণাঞ্চলের লবণাক্ততার কবল থেকে প্রজাসাধারণের সুপেয় পানির জন্য খনন করেন একাধিক দীঘি-নালা। কথিত আছে এ অঞ্চলে তিনি ৩৬০টি দীঘি খনন করেন। নির্মাণ করেন ছোট-বড় ৩৬০টি মসজিদ ও সরাইখানা। এ অঞ্চলে হযরত খানজাহান (রহঃ) এর অমর কীর্তির প্রধান নিদর্শন ষাটগম্বুজ মসজিদ। যা আজও স্ব-মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে।
মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি নেই। তাই এটিকে কবে নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। তবে মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী দেখলে নিশ্চিত ভাবে ধারনা করা হয় এটি খান-ই-জাহানের নির্মিত। ধারনা করা হয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান ই জাহান (খানজাহান আলী (রহঃ) নামে বেশি পরিচিত) মসজিদটি নির্মান করেন। এ মসজিদের পশ্চিম পাশে রয়েছে ঐতিহাসিক ঘোড়া দীঘি। যা দৃষ্টিনন্দন এ মসজিদের সৌন্দর্যকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। উত্তর-পূর্ব কোনে রয়েছে কোদাল ধোয়া দীঘি। উত্তরে ৩শ মিটার দূরে রয়েছে খানজাহানের বসত ভিটা বা ঢিবি এবং দক্ষিনে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক। খানজাহানের মাজার দরগাহ থেকে মসজিদটির দুরত্ব প্রায় আড়াই কিলোমিটার। আকৃতির বিচারে বাংলাদেশের ভূখন্ডে অবস্থিত মধ্যযুগীয় মসজিদ গুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় ষাটগুম্বজ মসজিদ। এটি হযরত খান জাহান (রহঃ) এর সর্ববৃহৎ কীর্তি বা নিদর্শন।
হযরত খানজাহান (রহঃ) এর সঠিক ইতিহাস আজও জানা যায়নি। শুধুমাত্র তার কবরগাত্রের শিলালিপি থেকে যেটুকু জানা যায়, তার উপাধী ছিল উলুখ খান আল আজম হযরত খানজাহান আলাইহে রহমত। ১৪৪০ সালের দিকে ভক্ত ও আশেকানদের নিয়ে তিনি বাগেরহাটে আসেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তিনি এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে রত ছিলেন। এরপর ভক্ত ও আশেকানদের কাঁদিয়ে ১৪৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর তিনি ইনতেকাল করেন (৮৬৩ হিজরি ২৬ জিলহজ্ব)। ইসলাম প্রচারের পাশাপাশি মানব সেবার ব্রত নিয়ে তিনি এ অঞ্চলে একটি ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে তার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এখানে তার সময়ে নির্মিত টিকে থাকা ও ধ্বংসপ্রাপ্ত রাস্তাঘাট, দীঘি-নালা ও বিভিন্ন স্থাপত্য দেখে ঐতিহাসিকরা এমনই ধারনা করছেন। ষাটগম্বুজ মসজিদ ছিল তার রাজ্যের পার্লামেন্ট ভবন। এখানে বসেই তিনি তার শাসন ও বিচার কাজ পরিচালনা করতেন।
মসজিদটি ষাটগুম্বজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গুম্বজ আছে ৮১ টি। মসজিদের চার কোনের মিনার বা বুরুজের উপরের ৪ টি গুম্বজ বাদ দিলে গুম্বজের সংখ্যা ৭৭টি। আর ৭৭ টি গম্বুজের মধ্যে ৭০টি গুম্বজের উপরিভাগ গোলাকার এবং মসজিদের মাঝ বরাবর গোলাকার গুম্বজগুলোকে ৭ টি চার কোনাবিশিষ্ট গুম্বজ দিয়ে সংযোগ করা হয়েছে। দক্ষিন-পূর্ব কোনের বুরুজটির ভিতর দিয়ে উপরে বা ছাদে উঠার সিঁড়ি আছে। এর নাম ‘রওশন কোঠা। আর উত্তর-পূর্ব কোনের বুরুজটি দিয়েও উপরে উঠার সিঁড়ি রয়েছে। এর নাম আন্ধার কোঠা নামে পরিচিত। তবে বর্তমানে আন্ধার কোঠাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ধারনা করা হয়, ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান ই জাহান এই মসজিদটিকে নামাযের কাজ ছাড়াও দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। আর বড় দরজাটি ছিলো দরবার ঘরের প্রবেশ পথ। কেউ কেউ আবার মসজিদটিকে সে সময়ে মাদ্রাসা হিসেবে ব্যবহৃদ হত বলে ধারনা করেন।
ষাটগুম্বজ মসজিদের পূর্ব-পশ্চিমে লম্বালম্বি ৭ টি সারিতে বিভক্ত মোট ৭৭ টি গুম্বজ আছে। গুম্বজ গুলোর ভার বহনের জন্য নিচের অংশে সারিবদ্ধভাবে ৬০টি পাথরের থাম বা পিলার আছে। মসজিদটি বাইরের দিক থেকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিক থেকে প্রায় ১৪৩ ফুল লম্বা। আর বাইরের দিক থেকে প্রায় ১০৮ফুট ও ভিতরের দিক থেকে প্রায় ৯০ ফুট চওড়া। দেওয়াল গুলো প্রায় ৮.৫ ফুট পুরুত্ব। মসজিদের ভিতরে মেঝে থেকে ছাদের উচ্চতা প্রায় ২১ ফুট। মসজিদের ভিতরের পশ্চিম দেয়ালে ১০টি মিহরাব আছে। মাঝের মিহরাবটি আকারে বড় এবং তুলনা মূলক অধিক কারুকায্য মন্ডিত। এ মিহরাবের দক্ষিনে ৫টি ও উত্তরে ৪টি মিহরাব আছে। শুধু মাঝের মিহরাবের ঠিক পরের জায়গাটিতে উত্তর পাশে একটি ছোট দরজা রয়েছে। মসজিদটিতে মোট ২৬ টি দরজা আছে। পূর্ব দেওয়ালে ১১ টি এবং উত্তর ও দক্ষিন দেওয়ালে ৭ টি করে দরজা আছে। আর পশ্চিম দেওয়ালে ১ টি দরজা। মসজিদের ভেতরে ৬০ টি স্তম্ভ বা পিলারই পাথর কেটে বানানো হয়েছে। এদের কয়েকটি আবার পাথরের বাহিরাবরণে ইটের গাঁথুনি দিয়ে ঢাকা ছিল। ধারণা করা হয় মসজিদের প্লাস্টার বিহীন দেওয়ালের সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখার জন্য এমনটা করা হয়েছিল।
ষাটগম্বুজ মসজিদের নামকরনের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, সংস্কৃত শব্দ ‘সাত’ ও ফারসি শব্দ ‘ছাদ’ এর উপর গম্বুজ থাকায় এটি ‘ছাদগম্বুজ’ থেকে ষাটগম্বু^জ হয়েছে। আবার কারো মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে দশটি করে মোট ষাটটি পাথরের খাম্বার উপর মসজিদের ছাঁদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ।
আবার কারও মতে মসজিদটির ছাঁদ সমতল নয়। এটি গুম্বজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গুম্বজ। যার থেকে মসজিদটি ‘ছাদগুম্বজ‘ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে কথ্যরুপে ‘ষাটগুম্বজ‘ নাম হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে,হযরত খানজাহান (রহঃ) ষাটগুম্বজ মসজিদ নির্মানের জন্য সমূদয় পাথর সুদূর চট্টগ্রাম আবার কারও মতে ভারতের উড়িষ্যার রাজমহল থেকে অলৌকিক ক্ষমতা বলে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। পুরো মসজিদ তৈরির মূল উপাদান চুন, সুরকি, কালোপাথর ও ছোট ইট। এই মসজিদের স্থাপত্যকলার সঙ্গে মধ্য এশিয়ার তুঘলক (তুরস্ক) স্থাপত্য শৈলির মিল রয়েছে বলে ধারনা বিশেষজ্ঞদের।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর বাগেরহাটে কর্মরত ও জাদুঘরের কাষ্টোডিয়ান মোঃ গোলাম ফেরদাউস ও ষাটগুম্বজ মসজিদের ইমাম মোঃ হেলাল উদ্দিন জানান, পাঁচ বছরের অধিক প্রত্যেকের জন্য ষাটগুম্বজ মসজিদ কম্পাউন্ডে প্রবেশ ফি বাধ্যতামূলক। দেশি পর্যাটকদের জন্য ২০ টাকা ও বিদেশি পর্যাটকদের জন্য ২০০ টাকা। তবে সার্কভূক্ত দেশ সমূহের নাগরিকদের জন্য ১০০ টাকা। আর মাধ্যমিক স্তর পর্যান্ত শিক্ষার্থীদের জন্য প্রবেশ ফি জন প্রতি ৫ টাকা। ঢাকার গাবতলী ও সায়েদাবাদ থেকে বাসে সরাসরি বাগেরহাট আসা যায়। এ ছাড়া কমলাপুর থেকে ট্রেনে খুলনা হয়ে বাগেরহাট আসা যায়। অপরদিকে ঢাকাণ্ডবাগেরহাট-খুলনা রুটের পরিবহণে স্বল্প সময়ে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে বাগেরহাটের ষাটগুম্বজ মসজিদে চলে আসতে পারেন।