রাজশাহীর তানোরে সপ্তাহ ধরে বৃষ্টি না হওয়ার প্রায় ৫ হাজার হেক্টর জমিতে রোপা আমন রোপন করতে পারেননি কৃষকরা। অপর দিকে খরার কবলে পড়ে শুকিয়ে গেছে রোপন করা রোপা আমনের জমি। ফলে, বৃষ্টির পানির জন্য শংকায় দিন কাটাচ্ছেন কৃষকরা।
তানোর উপজেলা কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, চলতি বছরে রোপা আমনের লক্ষ্য মাত্রা ধরা হয়েছে ২১ হাজার ৫ শ' হেক্টর। এর মধ্যে রোববার পর্যন্ত ১৪ হাজার ৫ শ' হেক্টর জমিতে রোপা আমন রোপন সম্পূর্ন হয়েছে। বৃষ্টির অভাবে এখনো পড়ে রয়েছে ৫ হাজার হেক্টর জমি।
তানোর উপজেলায় আবাদি জমি রয়েছে ২৩ হাজার ৯ শ' ৯৩ হেক্টর। এর মধ্যে সেচের আওতায় জমি রয়েছে ২২ হাজার ৩শ' ৩২ হেক্টর। সেচ বহির্ভূত জমি রয়েছে ১ হাজার ৬ শ' ৬১ হেক্টর। এর মধ্যে এক ফসলী জমি রয়েছে ৩শ' ৪৪ হেক্টর, দুই ফসলী জমি রয়েছে ৪ হাজার ৫শ' ৪০ হেক্টর, তিন ফসলী জমি রয়েছে ১৯ হাজার ১শ' ০৯ হেক্টর।
গত সপ্তাহের শুক্রবার ও শনিবার দুই দিনের টানা ভারি বর্ষনে কৃষকদের মধ্য উৎফুল্লতার সৃষ্টি হলেও গত ৮ দিনের মধ্য আর বৃষ্টির দেখা মেলেনি। ফলে, অনেক কৃষক তাদের জমি তৈরি করতে পারেন নি, আবার অনেকের তৈরি করা জমিতে রোপা আমন রোপন করতে না পারায় বর্তমানে শুকিয়ে গেছে।
কৃষকরা বলছেন, রোপা আমন চাষাবাদ মুলত বৃষ্টির পানির উপর নির্ভরশীল। যাদের জমির পরিমান বেশী তারা পর্যায়ক্রমে জমিতে রোপা আমন রোপন করেন। এই ভাবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে রোপা আমন রোপন করতে না পারা কৃষকরা দিশে হারা হয়ে পড়েছেন।
গত কয়েকদিন বিভিন্ন এলাকা সরে জমিন ঘুরে দেখা গেছে, নিচু এলাকার জমি গুলোতে রোপা আমন রোপন করা হয়েছে। কিন্তু উঁচু এলাকার জমি গুলো এখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। বৃষ্টির অভাবে রোপন করা যায়নি রোপা আমন। ১ সপ্তাহের মধ্যে রোপন করা না হলে জমি গুলো ফাঁকায় পড়ে থাকবে।
এর মধ্যে মুন্ডমালা পৌর এলাকাসহ বাধাইড় ও কলমা ইউপি এলাকায় ফাঁকা পড়ে রয়েছে বেশীর ভাগ জমি। এর মধ্য সব চাইতে বেশী জমি ফাঁকা পড়ে রয়েছে বাধাইড় ইউপি এলাকার জমি। বাধাইড় ইউপি এলাকার জুমার পাড়া, ধামধুম, ঝিনা, হাপানিয়া দৌগাছিসহ জোকার পাড়া এলাকার বেশির ভাগ জমি এখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে।
এই এলাকার জমি গুলোতে বেশী সময় ধরে পানি জমে থাকেনা। বৃষ্টি হওয়ার পর পরই জমিগুলো রোপন করতে পারেন নি কৃষকরা। ওই এলাকায় বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গভীর নলকুপের সংখ্যাও অনেক কম। ওই এলাকার জমি গুলোর চাষাবাদ নির্ভর করে বৃষ্টির পানির উপর। বেশ কয়েকজন বছর ধরে বেশীর ভাগ জমি পড়ে থাকে।
ফলে, ওই এলাকার বেশ কিছু জমিতে এখন গড়ে তোলা হয়েছে আম বাগান ও কুল বাগান। তবে, এখনো বেশীর ভাগ জমিতে ধানসহ অন্য ফসলের চাস করা হলেও এবছর এখন পর্যন্ত বেশীর ভাগ জমিতে রোপান করা হয়নি রোপান আমন। ওই এলাকায় যেসব জমিতে রোপান করা হয়েছে রোপান আমন সেই জমি গুলো বর্তমানে শুকিয়ে গেছে।
তানোর পৌরসভা, তালন্দ, সরনজাই, পাচন্দর, চান্দুড়িয়া, কামারগাঁ ইউপির বেশির ভাগ জমিতে রোপা আমন রোপন শেষ হয়েছে। কিন্তু ম্ন্ডুুমালা পৌরসভা ও পাচন্দর, বাধাইড় এবং কলমা ইউপির উঁচু জমিগুলো চাষ করা অবস্থায় পড়ে রয়েছে। এসব এলাকা প্রচন্ড খরাপ্রবন। জমি রোপনের দু,তিন দিন পানি না হলে শুকিয়র যায়। বিশেষ করে বাধাইড় ও মুন্ডুমালা পৌর এবং কলমা ইউপির উপর এলাকার জমিগুলো বেশিরভাগ চাষ অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
হয়তো একটি চাষ দিয়ে আবার অনেকের জমি মই দিয়ে সমতল করলেই রোপন হয়ে যাবে। এদিকে পাঁচন্দর ও কলমা ইউপির আংশিক জমি রোপন হয়নি। আবার কামারগাঁ ইউপি ছাঐড় মাঠে হিমাগার নির্মানের কারণে জমি পুকুরে রুপান্তর হয়ে পড়েছে। অতিরিক্ত পানির জন্য জমি চাষ পর্যন্ত করতে পারেননি।
ওই এলাকার বেশকিছু কৃষকরা বলছেন, হিমাগার নির্মানের শুরুতে বৃষ্টির পানি বের করার জন্য আমরা বলেছিলাম। কিন্তু কোন কর্নপাত না করে রাস্তার নয়নজুলি পর্যন্ত দখল করেছে। যার কারণে পানি বের হচ্ছেনা। আবার সপ্তাহ ধরে মাঝারি তাপপ্রবাহ বইছে, পানি থেকে চরম দূর্গন্ধ বের হওয়া শুরু হয়েছে। দ্রুত পানি বের করার ব্যবস্থা না করলে চাষাবাদ করা যাবেনা বলেও জানান কৃষকরা।
এছাড়াও বাধাইড় ইউপি ও মুন্ডুমালা পৌর এলাকা এবং কলমা ইউপির উত্তর পশ্চিমে হেক্টর জমি চাষ করা আছে। কিন্তু বৃষ্টি বা সেচের পানির অভাবে রোপন করতে পারছেন না রোপা আমন ধান। ফলে, অনাবাদি হয়ে পড়ে থাকবে এই এলাকার বেশীর ভাগ জমি। কৃষকদের দাবি এই উঁচু এলাকার জমি গুলোতে বিকল্প কোন ফসল উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হোক।
বাধাইড় গ্রামের কৃষক শফিকুলসহ ওই এলাকার সাদিকুল, দুরুল, বাচ্চুসহ অনেকে বলেন, রোপা আমন চাষ প্রতি বছর করে থাকেন কৃষকরা। এ আবাদই রোপা আমন এই এলাকার কৃষকদের জীবিকা নির্বাহের একমাত্র উপায়। বিগত সময়ে শ্রাবন মাস জুড়ে রোপন করা হত রোপা আমন।
কিন্তু আলু চাষের জন্য আষাঢ় ও শ্রাবনের প্রথম সপ্তাহের দিকেই রোপন হয়ে যায় রোপা আমন। বিগত কয়েক বছর ধরে সময়মত বৃষ্টির পানি না হওয়ার কারণে শতশত একর জমিতে কৃষকরা কৃষি জমিতেই আম, কুলসহ মিশ্র বাগান করেছেন।
কৃষকরা বলছেন দু' এক দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে এই এলাকার জমি গুলো ফাঁকা পড়ে থাকবে আবার যেসব জমিতে রোপান করা হয়েছে সেই জমিগুলোর রোপা আমন নষ্ট হয়ে যাবে এবং পুনরায় নতুন ভাবে জমি চাষ করতে হবে নয়তো ফাঁকাি পড়ে থাকবে। রোপন করা রোপা আমনের জমি গুলো ফেটে চৌচির হয়ে পড়েছে।
যাদের জমির পার্শ্বে খাল বা পুকুর আছে তারা কোন রকমে সেচ দিয়ে রোপনকৃত ধান গাছ রক্ষা করছেন। কিন্তু যারা সেচ দিতে পারছেন না তাদের রোপন করা ধান গাছের অবস্থা চরম আশঙ্কা জনক। পানি না পেলে মরে যাবে।
বাধাইড় গ্রামের কৃষক বয়োজ্যেষ্ঠ করিম মোল্লা বলেন, গভীর নলকূপ বা মটর থেকে সেচ দিচ্ছে না। আবার দিবে কি ভাবে, তারপরও সেচ দেয়ার জন্য চালু করলে অল্প সময়ের মধ্যে গভীর নলকূপ বিকল বা পানি উঠেনা। শতশত একর জমি চাষ করা আছে। ওই জমি গুলো বর্তমানর ফেটে গেছে। জরুরী ভিত্তিতে সেচ না দিলে ধান হবে না বলেও জানান তিনি।
তানোরের স্বর্ণ পদকপ্রাপ্ত আদর্শ কৃষক নুর মোহাম্মাদ বলেন, অতীতে শ্রাবন মাস জুড়েই জমি রোপন করা হত। কিন্তু আলু চাষের জন্য বর্তমানে কৃষকরা আগাম রোপন করে থাকেন রোপা আমন। এ কারণ রোপনের আগেই আলুর জন্য জমি লীজ হয়ে যায়। এসব টার্গেট করে কৃষকরা বীজও আগাম করেন।
তিনি বলেন, দু চার দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে বীজের বয়স হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে বয়স্কো বীজ রোপন করলে ফলন কম হবে। রোপা আমন বৃষ্টির পানি নির্ভর চাষাবাদ। কিন্তু জলবায়ুর বিরুপ প্রভাবের কারণে একদিন বৃষ্টি হচ্ছে তো ছয়/সাত দিন বৃষ্টির দেখা?,মিলছে না।
গত ১৪ জুলাই শুক্রবার শেষ বিকেল থেকে রাত পর্যন্ত এবং শনিবার ভারি বর্ষন হয়। ভারি বর্ষনের কারণে সপ্তাহের ব্যবধানে লক্ষমাত্রার দুভাগ জমি রোপন হয়েছে। বিশেষ করে মুন্ডুমালা, বাধাইড় ও কলমা ইউপির উপরি ভাগের জমিগুলোতে পানি নেই।
বৃষ্টির পানি পেয়ে কৃষকরা জমি চাষ করতে পারলেও রোপন করতে পারছেন না। গত ১৪ জুলাই শুক্রবার থেকে ২১ জুলাই শুক্রবার পর্যন্ত ৩৪, ৩৩, ৩৫ ও ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার সাথে ছিল রোদের প্রচন্ড প্রখরতা ও ভ্যাবসা গরম। ২১ জুলাই শুক্রবারে বৃষ্টির সম্ভবনা ছিল বলে আবহাওয়া দপ্তর অবহিত করেছিল। সন্ধ্যার পর থেকে মেঘলা আকাশ থাকলেও বৃষ্টি হয়নি। তবে বইছে বাতাস।
বাধাইড় ইউপি চেয়ারম্যান আতাউর রহমান বলেন, বৃষ্টির অভাবে ইউপির এলাকার বেশির ভাগ জমিতে রোপন করা যায়নি রোপা আমান। কিন্তু চাষ করা আছে, একটা ভারি বর্ষন হলেই কৃষকরা জমিতে রোপা আমন ধান রোপন করতে পারবেন। তিনি বলেন, যারা রোপন করতে পেরেছেন বর্তমানে তাদের জমিতে পানি না থাকায় শুকিয়ে গেছে। দু' চার দিনের মধ্যে বৃষ্টি না হলে ক্ষতির মধ্যে পড়বেন কৃষকরা। বৃষ্টি না হলে সেচের ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট দপ্তর গুলোর প্রতি উদার্থ আহবান জানান তিনি।
তানোর উপজেলা কৃষি অফিসার সাইফুল্লাহ আহম্মেদ বলেন, শ্রাবন মাস জুড়েই রোপা আমন রোপন করে থাকেন কৃষকরা। বৃষ্টির পানি না হলে অবশ্যই সেচের ব্যবস্থা করে জমি রোপনের ব্যবস্থা করা হবে। তিনি বলেন, কোন জমি ফেলে রাখার সুযোগ নেই। কৃষকের পাশে থেকে গত বোরো ও আউসে যেরকম বাম্পার ফলন হয়েছে, রোপা আমনেও হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।