ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। এ কথা সবারই জানা; তবে অনেকেই জানেন না, এ নদী ও খালের মধ্যে লুকিয়ে আছে কী অপরিসীম স্বর্গীয় সৌন্দর্য। সবকিছুই যেন ছবির মতো মনে হয়। তাইতো কবির ভাষায় “দেখা হয়নায় দুই চোখ মেলিয়া-ঘর হতে দুই পা ফেলিয়া”। পানিপ্রধান অঞ্চল বলে স্বভাবতই এখানকার জীবনযাত্রায় নৌকার ভূমিকা প্রবল। কতটা প্রবল তা সরেজমিনে কেউ না আসলে বোঝা যাবে না। কিছু কিছু এলাকার অধিবাসীদের বাণিজ্যের বেশ বড় একটি অংশ চলে জলে বসে। আর এ কারণেই বরিশাল, পিরোজপুর আর ঝালকাঠিতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ভাসমান হাট-বাজার।
হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, জলের ওপর ভাসমান এ বাজারটি যেন থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট। আসলে তা নয়; এটি বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের পিরোজপুরের কুড়িয়ানার ভাসমান পেয়ারার বাজার। বাংলার আপেলখ্যাত কুড়িয়ানার সুমিষ্ট পেয়ারারখ্যাতি রয়েছে দেশজুড়ে। এখানকার মানুষের আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস পেয়ারা। শত বছর ধরে কুড়িয়ানার গ্রামগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে পেয়ারা চাষ করা হচ্ছে। পেয়ারার ভরা মৌসুমে এখানে প্রতিদিন জলের ওপর নৌকায় ভাসমান হাট বসে।
পদ্মা সেতুর সুফলের কারণে দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ব্যবসায়ীরা ভাসমান পেয়ারার হাটে এসে পাইকারী দামে পেয়ারা ক্রয় করে নিয়ে যাচ্ছেন। কুড়িয়ানার মূল হাট-বাজারগুলো ভাসমান হওয়ায় এখানে শত বছর ধরে নৌকায় নৌকায় চলে বিকিকিনি। নদী ও খালের দেশ বরিশাল বিভাগের ঝালকাঠী ও স্বরূপকাঠীর বিভিন্নস্থানে বসে ভাসমান পেয়ারা বাজার। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে-ভিমরুলি, আটঘর ও কুড়িয়ানার ভাসমান বাজার। এই ভাসমান বাজারে পেয়ারার পাশাপাশি লেবু, পেঁপেঁ, কলা, বিলাতী গাবসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি পাইকারী দামে বিক্রি করা হয়। মৌসুমে প্রতিদিন কয়েক হাজার মন পেয়ারা বেচাকেনা হয় ভাসমান বাজারে। বাংলাদেশের উৎপাদিত মোট পেয়ারার প্রায় ৮০ ভাগই উৎপাদিত হয় ঝালকাঠির বিভিন্ন গ্রামে। আটঘর, কুরিয়ানা, ডুমুরিয়া, বেতরা, ডালুহারসহ বিভিন্ন এলাকার প্রায় ২৪ হাজার একর জমিতে পেয়রার চাষ করা হয়। আর এ পেয়ারা বেঁচা-কেনার জন্য ঝালকাঠির ভিমরুলি খালে জমে ওঠে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভাসমান পেয়ারার বাজার।
প্রতি বছরের জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে কয়েকশ’ কোটি টাকার পেয়ারা বিক্রি হয় এ ভাসমান বাজারে। ভিমরুলির খালজুড়ে সপ্তাহের প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভাসমান বাজার চলে। পেয়ারা বোঝাই শত শত নৌকা ভর্তি করে কৃষকরা আসেন ভাসমান বাজারে। খাল সংলগ্ন বাড়ি-ঘর, স্কুল, ব্রিজ, রাস্তাঘাটের দৃশ্য যেকোন মানুষকে বাংলার বুকে এক টুকরো থাইল্যান্ড বা ইতালির ভেনিসের অনুভূতি দিচ্ছে। প্রতিবছর পেয়ারার মৌসুমে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ভ্রমণপিপাসুদের জন্য এখানে গড়ে উঠেছে ফ্লোটিং পেয়ারা পার্ক। যেখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখরিত হয়ে ওঠে।
পেয়ারা বাগানে প্রবেশে পর্যটকদের জন্য ছোট ছোট নৌকা ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। ওইসব ছোট নৌকায় পর্যটকরা ঘুরে দেখেন পেয়ারা বাগান। আর এজন্য প্রতিবছর পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলায় জমে ওঠে নৌকার হাট। শতবছর ধরে সপ্তাহের প্রতি শুক্র ও সোমবার আটঘর কুড়িয়ানার মানপাশা বাজার সংলগ্ন আটঘর খালের নৌকার হাট বরিশাল অঞ্চলের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার সন্ধ্যা নদীতে সপ্তাহের প্রতি শনি ও মঙ্গলবার বসে বিশাল ধান আর চালের ভাসমান হাট। খুব সকাল থেকেই কয়েক’শ নৌকায় করে কারবারি ও গৃহস্থরা ধান, চাল নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। অনেকে আসে খালি নৌকা নিয়ে চাল ক্রয়ের জন্য। পুরো প্রক্রিয়াটাই চলে নদীতে বসে। ধানের বাজার ছাড়াও রয়েছে ভাসমান সবজির হাট। নাজিরপুরের বৈঠাকাঠা, উজিরপুরের হারতা, মাহমুদকাঠিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় রয়েছে ভাসমান সবজির বাজার। এখানেও স্থানীয় মানুষজন তাদের শাকসবজি নৌকায় করে নিয়ে এসে নৌকায় বসেই বিক্রি করে থাকেন। সকাল থেকেই জমে ওঠে এ বাজার। শান্ত জলের ওপর সবজি বোঝাই নৌকাগুলোতে বেচাকেনা চলে হরদম। উজিরপুরের হারতার ভাসমান সবজির বাজার বসে সপ্তাহের প্রতি রবি ও বুধবার। নাজিরপুরের বৈঠাকাঠার ভাসমান সবজির হাট বসে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার। আটঘর, কুড়িয়ানা ও ভিমরুলির ভাসমান পেয়ারা বাজার বসে প্রতিদিন (জুলাই থেকে অক্টোবর মাসে)। এরমধ্যে ঝালকাঠির সদর উপজেলার কীর্তিপাশা ইউনিয়নের ভীমরুলি, পিরোজপুরের স্বরুপকাঠি উপজেলার আটঘর কুড়িয়ানা ইউনিয়নের আটঘর ও কুড়িয়ানা এলাকার বিভিন্ন খালের ভেতরে অবিস্থত ভাসমান হাটগুলো মৌসুমী ফসল ও শাক-সবজির জন্য বিখ্যাত। সব বাজারই খুব সকালে বসে এবং দুপুরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। স্বাভাবিক সময়ে সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে নদী ও খালে বসে এ ভাসমান হাট। তবে ফল-ফসলের মৌসুমে প্রতিদিনই ভাসমান এ হাটগুলো জমে ওঠে। তবে পেয়ারা বা আমড়ার মৌসুমে আটঘর-কুড়িয়ানার ভাসমান হাটগুলো বেশি জমজমাট থাকে। এসব হাটের ক্রেতারা মূলত পাইকার নামে পরিচিত। ফলে ভাসমান এসব হাটে খুচরা ক্রেতারা তেমন গুরুত্ব পায় না। হাটেরদিন বড় বড় ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে এসব হাটে আসেন পাইকাররা। এসব ভাসমান হাট থেকে মৌসুমী ফল, ফসলসহ বিভিন্ন পণ্য ক্রয় করে পাইকাররা ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্নস্থানে নিয়ে যায়। দেশের শস্যভান্ডার বলেখ্যাত বরিশাল অঞ্চলে স্বল্প খরচে উৎপাদিত ফল-ফসল খুব সহজেই ভাসমান হাটের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারায় কৃষকরাও লাভবান হচ্ছেন। ফলে ক্রমেই ঝালকাঠি, পিরোজপুর ও বরিশাল অঞ্চলে ফসল ও ফলের চাষাবাদে বিপ্লব ঘটেছে।
ভাসমান পেয়ারা বাজার ॥ বাংলাদেশের ভাসমান পেয়ারা বাজার বসে জলের দেশ বরিশালের ঝালকাঠী ও স্বরূপকাঠীর বিভিন্ন জায়গায়। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ভিমরুলি, আটঘর, কুড়িয়ানা বাজার। অনেকে এই ভাসমান বাজার সমুহকে থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেটের সাথে তুলনা করে থাকেন। জুলাই থেকে আগস্ট মাসের প্রতিদিনই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কয়েক হাজার মন পেয়ারা বিকিকিনি হয় এসব ভাসমান হাটে। পেয়ারার বাজারের সাথে রয়েছে, মৌসুমী ফল আমড়া, চালতা, বিলাতি গাব, কলা, সুপারিসহ নানা ধরনের সবুজ তরকারির ভাসমান পসরা।
নৌকার ভাসমান হাট ॥ নৌকার হাট মানে নৌকার ওপর বাজার নয়; নতুন নৌকা কেনা বেচার জন্য খালের পাড়ে সারি সারি শত শত নতুন নৌকা সাজানো রয়েছে। চলছে বর্ষাকাল। চারিদিকে বর্ষার পানিতে টুইটুম্বর। আর এ সময় দক্ষিণের মানুষের অন্যতম বাহন হয়ে ওঠে নৌকা। আর সাধারণ মানুষের এই চাহিদার কথা চিন্তা করেই আটঘর কুড়িয়ানা, পিরোজপুরের স্বরূপকাঠী, বরিশালের গৌরনদীর মাহিলাড়া ও আগৈলঝাড়ায় শত বছরের বেশি সময় ধরেই বসছে নৌকার ভাসমান হাট।
বাঁশের চাঁইয়ের ভাসমান হাট ॥ বর্ষাকালে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকায় দেশি প্রজাতির মিঠাপানির মাছ শিকারের জন্য ব্যবহার করা হয় বাঁশের তৈরি বিশেষ ফাঁদ (চাঁই)। গ্রামাঞ্চলে মাছ ধরার সবচেয়ে আদি উপকরণের মধ্যে একটি হচ্ছে বাঁশের তৈরি চাঁই। গ্রীস্মের শুরু থেকে গ্রামাঞ্চলের খাল-বিল ও নদী-নালায় চাঁই দিয়ে মাছ ধরার ধুম পরে যায়। যা চলতে থাকে ভাদ্র-আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত। উপকূলের বিভিন্ন উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে মাছ ধরার এ উপকরণটির বাজারজাত ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। প্রতিদিন বাজারে হাজার হাজার চাঁই বিক্রি হচ্ছে। পিরোজপুরের ভান্ডারিয়ার পোনা নদী তীরবর্তী দক্ষিণ বাজার, ভুবনেশ্বর খালে শত বছরের ঐতিহ্য নিয়ে আজো টিকে আছে ভাসমান চাঁইয়ের সবচেয়ে বড় মোকাম। সপ্তাহে প্রতি শনি ও মঙ্গলবার ভান্ডারিয়ায় ভাসমান চাঁইয়ের হাটের দিন থাকায় এখান থেকে পাইকারী মূল্যে ক্রয়ের পর ব্যবসায়ীরা গ্রামীণ জনপদের বিভিন্ন হাট-বাজারে এসব চাঁই বিক্রি করেন।