আজ ২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। বাঘ সংরক্ষনে ব্যাপক গন সচেতনতা সৃষ্টি করার লক্ষ্যে দিবসটি দীর্ঘ বছর ধরে বিভিন্ন প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে পালিত হচ্ছে। এ বছর সুন্দরবনের শরণখোলা, চাদপাই খুলনা ও সাতক্ষীরা ৪টি রেঞ্জে “বাঘ করি সংরক্ষণ সমৃদ্ধ হবে সুন্দরবন” এ প্রতিপাদ্য বিষয়কে সামনে রেখে আজ দিবসটি পালিত হচ্ছে। সুন্দরবন সুরক্ষায় আলাদা মন্ত্রণালয়ের দাবি জানিয়েছেন খুলনা সুন্দরবন একাডেমি। সুন্দরবনের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয় না থাকলে বন সুরক্ষা একসময় কঠিন হয়ে পড়বে। বাঘের অস্তিত্ব রক্ষা না হলে সুন্দরবন বিপন্ন হবে।
বীরত্বের প্রতীক, জাতীয় প্রাণী ও প্রকৃতিক প্রহরী রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল বিশ্বখ্যাত সুন্দরবন। বাঘ বনের জীববৈচিত্র, খাদ্য শৃঙ্খল ও প্রতিবেশ চক্রের প্রধান নিয়ন্ত্রক। বন বিভাগ সূত্রে জানা যায় ২০১৮ সালে সর্বশেষ জরিপে বাঘের সংখ্যা ১১৪ টি। কিন্তু পূর্ব সুন্দরবনে ২০১৯ সালের ২১ আগস্ট থেকে ২০২২সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছরের ব্যবধানে ৪ টি বাঘের মৃত দেহ উদ্ধার করে বনবিভাগ। অপরদিকে ২০২১ সালের ১৯ জানুয়ারি পাচারকালে ১ টি বাঘের চামড়া সহ এক পাচারকারীকে আটক করে র্যাব-৮ ও বনবিভাগ। পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে বাঘের একটি মৃতদেহ উদ্ধার করে বন বিভাগ এবং র্যাব-৬ একই রেঞ্জ থেকে চলতি বছরে একটি বাঘের চামড়া উদ্ধার করে। ঐ হিসাব থেকে কমে গেল ৭ টি বাঘ। এ মুহুর্তে সুন্দরবনে কয়টি বাঘ আছে তার সঠিক হিসাব নেই বনবিভাগের কাছে। কারণ গত চার বছর পর চলতি বছরের জানুয়ারী মাসে ক্যামেরা ট্রাকিং পদ্ধতিতে বাঘ গণনার কাজ শুরু হয়েছে। ২০২৪ সালের জুন মাসের দিকে বাঘ গননার ফলাফল ঘোষণা করা হবে বলে বন বিভাগ সূত্র জানিয়েছে। বর্তমানে বাঘের সংখ্যা বাড়ছে না কমছে এ প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
বন বিভাগের একটি সূত্র জানায়, পর্যটক ও বিভিন্ন শ্রেণি পেষার যে সব মানুষ বনে গেছে তারা ডিমেরচর, সুকপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় মাঝে মাঝে বাচ্চা সহ বাঘ দেখেছে। এ ছাড়া গত মাসের প্রথম দিকে বিকালে বেলা কচিখালি অফিস চত্তরে বাঘ এসে অবস্থান নেয়। দীর্ঘ সময় বাঘ না সড়লে একপর্যায়ে রাইফেলের ফাাঁকা গুলি করে তাড়ানো হয়। তাতে মনে হচ্ছে সুন্দরবনে বাঘ বেড়েছে। সুন্দরবনের বাঘসহ বন্য প্রাণীর আবাসস্থল বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৬ লাখ ১ হাজার ৭ শত হক্টর বনের মধ্যে বর্তমানে ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর অভয়ারণ্য বন রয়েছে। যা ১৯৯৬ সালে মোট বনের ২৩%, এবং পরে সম্প্রসার করায় বর্তমানে ৫৩% অভয়ারন্য এলাকা রয়েছে। যার আয়তন ৩ লাখ ১৭ হাজার ৯৫০ হেক্টর।
বাঘ বিশেষজ্ঞ খসরু চৌধুরীর ভাষ্যমতে, ২০১০ সালে এই দিনে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে বিশ্বের বন্য অধ্যুষিত ১৩ টি দেশের প্রতিনিধিরা বাঘ রক্ষায় সম্মতি স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সম্মেলনের উদ্যোক্তা ছিল বিশ্ব বন্য প্রাণী তহবিল ( ডাব্লিউ ডাব্লিউ এফ)। আর অর্থায়নে ছিল বিশ্ব ব্যংক। উদ্দেশ্য ছিল ২০২২ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা দ্বিগুণ করা। শ্লোগান ছিল “বাঘের বেঁচে থাকা আমাদের হাতে”। কিন্তু তা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে সেটা ২০২৪ সালে জরিপের গননার ফল ঘোষনার পরে জানা যাবে।
একটি নির্ভর যোগ্য সূত্র জানায় ২০১৮ সালের জরিপ অনুযায়ী সুন্দরবনের ১১৪ টি বাঘের মধ্যে যদি ২০টি প্রাপ্ত বয়স্ক স্ত্রী বাঘও থাকে তাদের থেকে প্রতিবছর কমপক্ষে ২০ থেকে ৪০টি বাঘ বৃদ্ধি পাওয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেখানে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে না। এর কারণ হতে বাঘের জিনগত বৈচিত্রেরের অভাব। অল্প বাঘ থাকায় তাদের মধ্যে ইনবিডিং তথা নিকট সম্পর্কের মধ্যে প্রজনন হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। এতে বাঘ শাবকের মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। তাই বাঘ সংরক্ষণে মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। এজন্য বাঘের জিনগত বৈচিত্র আনা প্রায়োজন। হেটারোজেনোসিটি বৃদ্ধি করতে পারলে বাঘের বংশ যেমন বৃদ্ধি পাবে সেই সঙ্গে বাঘের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও যে কোন পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর মাধ্যমে বাঘকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে। তার ভাষ্যমতে ভারতে ২০১৯ সালের জরিপ অনুসারে বাঘ আছে ৯৬ টি। কিন্তু এ সংখ্যা ২০১৭ সালে ছিল ৮৭ টি। মাত্র ৩ বছরের ব্যবধানে বাঘ বেড়েছে ৯ টি। বাংলাদেশের তুলনায় ভারতীয় সুন্দরবন অংশে বাঘ বৃদ্ধির লক্ষ্যে সেখানকার বনবিভাগ অনেকদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। ফলে ভারতে বাঘের সংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে দক্ষিণ অঞ্চলে যে হারে জলবায়ু পরিবর্তন শুরু হয়েছে তাতে সুন্দরবনের বাঘ রক্ষায় মানুষ ও প্রাকৃতিক কারণগুলো ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জিনগত বিষয়টির দিকেও নজর দিতে হবে। এত অল্প সংখ্যক বাঘের প্রবল জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা করে টিকে থাকা ভবিষ্যতে খুবই কষ্ট সাধ্য হবে। তাই অন্যান্য ব্যবস্থার পাশাপাশি পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে বাঘের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি করার বিষয় কাজ শুরু করা উচিত।
খুলনা সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক ডঃ মো: আনোয়ারুল কাদির বলেন, বাঘের বিচরণ ক্ষেত্র প্রজনন জায়গাটা অনুকূলে নিশ্চিত করা দরকার। বাঘ বিচারনের জন্য পরিবেশ বান্ধব ক্ষেত্র প্রয়োজন। সুন্দরবন রক্ষায় প্রশাসন সহ সর্বমহলের সহযোগিতা দরকার। সুন্দরবন সুরক্ষায় এ যাবৎ যতগুলো প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে কোনোটিই সফলতার মুখ দেখেনি। পরিকল্পনা হীনতা ও সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। যে কারণে সুন্দরবন সুরক্ষায় আলাদা মন্ত্রণালয় না হলে যতই প্রকল্প হাতে নেওয়া হোক না কেন তা সফল বাস্তবায়ন হবে না। সুন্দরবন সুরক্ষায় আলাদা মন্ত্রনালয় প্রয়োজন। এ দাবী অনেক দিনের। তা না হলে একসময় সুন্দরবন সুরক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। ধারণা করা হচ্ছে এবারের জরিপ শেষ হলে বাঘের সংখ্যা বাড়তে পারে।
সুন্দরবন খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো বলেন, “বাঘ করি সংরক্ষণ সমৃদ্ধ হবে সুন্দরবন” এই প্রতিপদ্য বিষয়কে সামনে রেখে এবারে সুন্দরবন দিবস পালিত হচ্ছে সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে। খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার পশ্চিম সুন্দরবনের ক্যামেরা ট্রাপিং পদ্ধতিতে বাঘ গননার কাজ শেষ হলেও কিছু কাজ বাকি আছে। পশ্চিম সুন্দরবনে বিভিন্ন জায়গায় ৪৬৮ টি ক্যামেরা বসিয়ে গননার কাজ করা হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে পূর্ব সুন্দরবনের বাঘ গননার কাজ শুরু হবে নভেম্বর মাসে। গণনার কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাঘ বেড়েছে কিনা তা বলা যাবে না। আগামী ২০২৪ সালের জুন মাসে প্রকাশ করা হবে বাঘ গণনার ফলাফল। তখন বলা যাবে সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কত।