দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আসন্ন। দলীয় মনোনয়ন পেতে মাঠে দৌঁড় ঝাঁপ করছেন প্রার্থীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে (সরাইল-আশুগঞ্জ) ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশী। ইতোমধ্যে নৌকা প্রত্যাশীর সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে ডজনের উপরে। তবে এবার এই আসনে নৌকা মার্কার প্রার্থী চাই স্থানীয় আ’লীগ। তাদের মতে শেখ হাসিনা সরকারের আমলে সারা দেশে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে। কিন্তু নৌকা মার্কার এমপি না থাকায় এখানকার নেতৃত্ব খুবই দূর্বল। ফলে জোয়ারের সময়ও উন্নয়ন বঞ্চিত হয়েছে সরাইল আশুগঞ্জের মানুষ। নৌকার জন্য এই আসনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জোট/ মহাজোটের প্রার্থী। কারণ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের পর এখানে নৌকার প্রার্থী জয়লাভ করতে পারেনি। নবম সংসদ নির্বাচনে আ.লীগ সেই বন্ধাত্ব ঘুছিয়েছিল মহাজোটের অন্যতম শরীক জাপা’র প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়ে। ভবিষ্যতেও জোট/মহাজোট থাকলে এখানে নৌকা মার্কার প্রার্থী অনেকটা অনিশ্চিত। এরপরও এই আসনের নির্বাচনে আরেকটি জটিল সমীকরণের জন্ম দিয়েছেন বিএনপি’র দলত্যাগী নেতা উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া। বিএনপি দলীয় এমপি সাত্তার সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আবার একই আসনের উপনির্বাচনে স্বতন্ত্রপ্রার্থী হয়ে নৌকা বিহীন মাঠে নির্বাচন করেছেন। জেলা উপজেলার আ.লীগের নেতাদের প্রকাশ্য সহযোগিতায় আবদুস সাত্তার জয়লাভও করেছেন। তাই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে ওঁর হাত বাড়ানোর সম্ভাবনাকেও উড়িয়ে দেয়া যায় না। মহাজোটে রয়েছে জাপা। তবে সরাইলের জাপা এখন দুই ভাগে বিভক্ত। প্রার্থীও দুইজন। রওশন এরশাদের সমর্থিত প্রার্থী এই আসনের দুইবারের সাবেক এমপি এড. জিয়াউল হক মৃধা। আর জি এম কাদেরের প্রার্থী এড. রেজাউল ইসলাম ও এড. আবদুল হামিদ ভাসানী। গত উপনির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীকে এখানে নির্বাচন করেছেন আবদুল হামিদ।
সরজমিনে, তৃণমুল ও দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, আগামী সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ৬-৭ মাস। তাই প্রার্থীদের দৌঁড়ঝাঁপ বাড়ছে। দলীয় মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর সংখ্যাই বেশী। তারা প্রত্যেকেই জাতীর জনকের কন্যা সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনি, ডিজিটালাইজেশন, পদ্মাসেতু, ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেলসহ দেশের উল্লেখযোগ্য সকল উন্নয়ন কর্মকা- মানুষের সামনে তুলে ধরছেন। নৌকা প্রতীক পাওয়ার বিষয়ে খুবই আশাবাদী সংরক্ষিত নারী আসনের (৩১২) এমপি, ৩ সদস্যের সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক উম্মে ফাতেমা নাজমা বেগম। তিনি বলেন, নৌকার জন্য মাঠে কাজ করছি। দলীয় প্রধানের সিদ্ধান্তের বাহিরে কখনো যায়নি। ভবিষ্যতেও যাব না।
আ’লীগ দলীয় প্রতীকে এই আসনে নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখছেন কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক নেতা মো. মঈন উদ্দিন মঈন। তিনিও বিভিন্ন সভা সেমিনারের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগদান করছেন। মঈন উদ্দিন বলেন, গত নির্বাচনে অল্প ভোটের ব্যবধানে হেরেছি। মানুষ চায়। তাই মাঠে আছি। দল মনোনয়ন দিলে নির্বাচন করব। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি দলীয় প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তার ভূঁইয়া ৮৩ হাজার ৯৯৭ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্ধী আ.লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তৎসময়ের জেলা আ.লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাঈন উদ্দিন পেয়েছিলেন ৭৫ হাজার ৪১৯ ভোট।
আ’লীগ দলীয় মনোনয়ন পেতে দীর্ঘদিন ধরে মাঠে ময়দানে কাজ করছেন শহিদ বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আকবর হোসেন বকুল মিয়ার সন্তান আ.লীগ নেতা এড. সৈয়দ তানবির হোসেন কাউসার। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের জন্য আত্মত্যাগকারী পিতার সন্তান নিজ আসনের মানুষের জন্য কাজ করছেন। শেখ হাসিনার গত ১৫ বছরের উন্নয়ন বার্তা নিয়ে তিনি ছুটছেন তুণমূল ভোটারদের কাছে। নৌকা প্রতীক পেলে ৭৩ এরপর হারানো আসনটি পূর্ণোদ্ধার করে শেখ হাসিনাকে উপহার দেয়ার বিষয়ে তিনি অঙ্গিকারবদ্ধ। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা, বাংলাদেশ আইন সমিতির সাবেক সভাপতি ও অরূয়াইল আবদুস সাত্তার ডিগ্রী কলেজের গভর্নিং বোর্ডের সভাপতি এড. কামরূজ্জামান আনসারী নির্বাচনী এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। মসজিদ, মন্দির, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সকল আচার অনুষ্ঠানে তাঁর সরব উপস্থিতি নিয়মিত। দলীয় মনোনয়ন পেতে তিনি লড়ছেন দীর্ঘদিন ধরে। এলাকা ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার অঙ্গিকারও করছেন তিনি। এই আসনে আ.লীগ দলীয় এমপি হওয়ার স্বপ্ন তাঁর অনেক পুরনো। দল মনোনয়ন দিলে স্বপ্ন পূরণের বিষয়ে তিনি খুবই আশাবাদী। বেসরকারী শিক্ষক কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ মো. শাহজাহান আলম সাজুও নির্বাচনী মাঠে কাজ করছেন নিয়মিত। গ্রাম পাড়া মহল্লার মানুষের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা দীর্ঘদিনের। প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন বার্তা নিয়ে ঘুরছেন নির্বাচনী এলাকার মানুষের দ্বারে দ্বারে। সাধ্যমত গরীব অসহায় মানুষদের উপহার দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নৌকা প্রতীক নিয়ে এমপি হওয়ার স্বপ্ন তার দীর্ঘদিনে। দলীয় মনোনয়ন চান ৩ সদস্যের সরাইল উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ নাজমুল হোসেন। উপজেলা আ.লীগের সাবেক সম্পাদক ও উপজলা পরিষদের দ্বিতীয়বার নির্বাচিত চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুরও মনোনয়ন প্রত্যাশার কথা জানান দিয়ে যাচ্ছেন। নৌকা চান উপজেলা আ.লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট আবদুর রাশেদ, জেলা আ.লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল হান্নান রতন, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য বিশিষ্ট ব্যবসায়ি মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ও আ.লীগের মনোনয়ন পেতে প্রচার প্রচারণা করছেন উপজেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট আশরাফ উদ্দিন মন্তু। বাংলাদেশ আ.লীগের স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা বিষয়ক উপকমিটির সদস্য, ঢাকা ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ঢাকাস্থ সরাইল সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক-১ ডা: আশীষ কুমার চক্রবর্তীও নৌকা প্রত্যাশা করছেন। তিনি বলেন, সহিংসু নয়, আমি অহিংসু রাজনীতি করি। সুযোগ পেলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করে বাংলাদেশের মধ্যে সরাইলকে মডেল করব।
মাঠে কাজ করছেন মহাজোটের (এরশাদ) পরপর দুইবারের নির্বাচিত সাবেক এমপি এড. জিয়াউল হক মৃধা। তিনি গ্রামে গঞ্জে পাড়া মহল্লায় ও উপজেলার সভা সেমিনারে নিয়মিত উপস্থিত হয়ে ওঁর আমলে সরাইল-আশুগঞ্জের উল্লেযোগ্য উন্নয়ন কর্মকান্ডের কথা বলছেন। গত সাড়ে ৪ বছর ধরে এই আসনের উন্নয়নের চাকা বন্ধ থাকার বার্তাও দিচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে এই আসনে মহাজোট থেকে তিনিই মনোনয়ন পাবেন ও এমপি হবেন এমন ঘোষণা প্রকাশ্য সভায় দিচ্ছেন। জিয়াউল হক মৃধা বলেন, আমার আমলে সবচেয়ে গুরূত্বপূর্ণ সরাইল-অরূয়াইল সড়ক নির্মাণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভবন অনুমোদন, সড়ক পাকাকরণসহ দৃশ্যমান উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করেছি। এটি মহাজোটের আসন। গত উপনির্বাচনে এখানে জাতীয় পার্টির (জিএম কাদের) মনোনয়ন পেয়েছিলেন এড. আবদুল হামিদ ভাসানী। ভবিষ্যতেও জাপার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়ে তিনি দূঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করছেন। তবে আ.লীগ দলীয় একাধিক সূত্র জানায়, এই আসনে ৭১ এরপর নৌকা জয়লাভ করেনি। নবম সংসদ নির্বাচনে জাপার সাথে জোট করলে লাঙ্গল প্রতীকে মহাজোটের প্রার্থী মৃধা বিশাল ভোটের ব্যবধানে মুফতি আমিনীকে পরাজিত করে স্বাধীনতার পর প্রথম আ.লীগের বন্ধাত্ব ঘুচিয়েছিলেন। গত উপনির্বাচনেও দলের হাই কমান্ড এখানে নিজেদের দলের শক্তিশালী ৪ প্রার্থীকে একসাথে মনোনয়ন প্রত্যাহার করিয়ে চমক দেখিয়েছেন। এক সময়ের ভোটের মাঠের শত্রƒকে বন্ধু করে বুকে টেনে নিয়েছিলেন আ’লীগ। জেলা উপজেলা আ.লীগের সকল নেতা কর্মী ভোটের মাঠে লড়াই করে বিএনপি’র দল ত্যাগি নেতা বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, একাধিক দপ্তরের সাবেক প্রতিমন্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী উকিল আবদুস সাত্তারকে জয়লাভ করিয়েছেন। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে এই আসনে নৌকা অনেকটাই অনিশ্চিত। মূল ফ্যাক্ট জোট বা মহাজোট। এখানে উকিল আবদুস সাত্তার বা তাঁর সমর্থিত প্রার্থী আসার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসতে পারে মহাজোটের অন্যতম শরীক জাপার প্রার্থীও। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রদানে এখানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার চমক দেখার অপেক্ষায় আছে দলটির তৃণমূলের নেতা কর্মীরা।
নৌকা প্রতীকে ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ:
প্রার্থী এক ডজনের অধিক হলেও নৌকা প্রতীকের বিষয়ে সকলেই ঐক্যবদ্ধ। নেত্রী নৌকা যাকে দিবেন তার জন্য সকলে মিলে কাজ করার দূঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তারা। অতীত ভুলতে চান এখানকার আ.লীগের নেতারা। আর শত্রƒর সাথেও নৌকার স্বার্থে বিরোধীতা না করার অঙ্গীকার করছেন। গত শ্রমিক দিবসের জনসভায় রফিক উদ্দিন ঠাকুর, এড. সৈয়দ তানবির হোসেন ও এড. কামরূজ্জামান আনসারী বলেছেন, আমরা এখানে কলার ছড়া, হাতি বাতি ইত্যাদি চাই না। আমরা চাই নৌকা মার্কার প্রার্থী। দল যাকে দিবে, তাকেই আমরা জয়লাভ করাব।
প্রসঙ্গত: জেলার সরাইল ও আশুগঞ্জ উপজেলা নিয়ে এই আসন। ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে সরাইল আর ৮টি ইউনিয়ন রয়েছে আশুগঞ্জে। ১৭ টি ইউনিয়নে মোাট ভোটার তিন লাখ ৭০ হাজার ১২৩ জন। এরমধ্যে সরাইল উপজেলার ৯ টি ইউনিয়নে মোট ভোটার ২ লাখ ৩৭ হাজার ১৫৩ জন। আশুগঞ্জ উপজেলার ৮টি ইউনিয়নে ভোট সংখ্যা ১ লাখ ৩২ হাজার ৯৭০ জন।