অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলো শিল্প খাত। এ ক্ষেত্রে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান সবচেয়ে বেশি। এ খাত শুধু দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারকেই সমৃদ্ধ করেনি, একইসঙ্গে নিশ্চিত করেছে অগণিত মানুষের কর্মসংস্থান। তৈরি পোশাক দেশের সর্ববৃহৎ রপ্তানিমুখী খাত। বিগত কয়েক দশক ধরে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে তৈরি পোশাক শিল্প প্রথম স্থান দখল করে রাখতে সক্ষম হয়েছে। দেশে এখনো তৈরি পোশাক শিল্পের বিকল্প কোনো খাত তৈরি হয়নি। বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্প যাত্রা শুরু করে ষাটের দশকে। তবে সত্তর দশকের শেষার্ধ থেকে মূলত এটি রপ্তানিমুখী খাত হিসেবে এ দেশে আত্মপ্রকাশ করে। স্বাধীনতার মাত্র ৭ বছর পরে প্রায় শূন্য থেকে শুরু করে মাত্র ১২ বছরের মধ্যেই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছা যাওয়ার সাথেসাথে দশ লাখের অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করে এই সম্ভাবনাময় শিল্পখাত। আশির দশক পর্যন্ত মোট রপ্তানির ৫০ শতাংশ ছিল পাট ও পাটজাত পণ্য। এরপর পাটকে পেছনে ফেলে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫২.০৮ বিলিয়ন ডলার। ইতিহাসের সর্বোচ্চ রপ্তানি আয়ের মধ্যে শুধু তৈরি পোশাক শিল্প থেকে রপ্তানির পরিমাণ ৪২.৬১৩ বিলিয়ন ডলার। তৈরি পোশাক শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে বস্ত্র, সুতা, আনুষঙ্গিক উপকরণ, প্যাকেজিং ইত্যাদি শিল্পেরও ঘটেছে সম্প্রসারণ। এর বাইরেও পরিবহন, ব্যাংকিং, শিপিং এবং ইন্স্যুরেন্স সেবার চাহিদাও বৃদ্ধি পেয়েছে পোশাক শিল্পের কল্যাণে। পাশাপাশি বিশ্বের অনেক দেশেরই প্রধান পোশাকের উৎস বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পোশাকের উচ্চ মান ও ন্যায্য দামের ফলে বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এখন ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নামটি পরিচিত হয়ে উঠেছে। কিন্তু সস্প্রতি সংকটের মুখে পড়েছে এই পোশাক শিল্প। বিশ্বজুড়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং পোস্ট করোনার ধাক্কায় টালমাটাল অর্থনীতিতে নতুন সমস্যার কারণ হতে যাচ্ছে এই তৈরিকৃত পোশাক শিল্প। ২০২২ সালের অক্টোবর থেকেই বাংলাদেশে কমতে শুরু করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্ডারের পরিমাণ। এক প্রতিবেদনে দেখা যায় ২০২৩ সালে বাংলাদেশের পোশাকের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশ কমেছে। তার উপর দেশে ক্রমাগত বিদ্যুৎ ও জ্বালানীর মূল্য বৃদ্ধি ও উন্নত প্রযুক্তি এবং দক্ষ জনবলের ঘাটতিতে এই শিল্প ঝুঁকির মুখে পড়ছে। পাশাপাশি শ্রমিকের মজুরি, নিরাপত্তাও একটি বড়ো অন্তরায় এই শিল্পের জন্য। কিন্তু আশার কথা হলে ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ বাজার যুক্তরাজ্য গত অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৪.৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক আমদানি করেছে। যুক্তরাজ্যের প্রধান আমদানি উৎস চীনের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি সেখানে দিন দিন হ্রাস পাঁচ্ছে। ফলে সেখানেও বাংলাদেশের পোশাক পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি পাঁচ্ছে। এই শিল্পকে সম্প্রসারণ ও সহজ করতে সরকার ও এই শিল্পণ্ডসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এখনই টেকসই কর্মপরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। এইজন্য আমাদের দেশের ব্যাংকসমূহকে এগিয়ে আসতে হবে। কোনো উদ্যোক্তা বিনিয়োগ করলে তাতে সুদের কম ধরতে হবে। এতে করে বিনিয়োগকারীগণ উৎসাহিত হবেন। শ্রম উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি ও কাজের পরিবেশ উন্নয়নের বিকল্প নাই। এজন্য শ্রমিকের বেতন বৃদ্ধি এবং তার নিরাপত্তা ও জীবনের মান উন্নয়নের বিষয়টিও অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি, উদ্ভাবন, কাজের পরিবেশ সৃষ্টি, শ্রমিক মালিকের সম্পর্ক উন্নয়ন শুধু এই শিল্পখাতের উন্নয়নের জন্যই নয় বরং গোটা অর্থনীতির স্বার্থেই জরুরী। সুতরাং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এই খাতের উন্নয়নের বিকল্প নেই।