মোবারক হোসেন শিশিররিকশা চালকের ছেলে ও গরুর রাখালের মেয়ে দারিদ্রতাকে হার মানিয়ে ৪১তম বিসিএস সাধারন (শিক্ষা ও ভ্যাটেনারি সার্জন) ক্যাডার-এ চুড়ান্ত নিয়োগের সুপারিশ পেয়েছে। হতদরিদ্র পরিবার থেকে দুই মেধাবী বিসিএস-এ নিয়োগের সুপারিশ পাওয়ায় তাদের শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন উপজেলা প্রশাসন সহ বিভিন্ন্ মহল।
রাজশাহীর দুর্গাপুর উপজেলার জয়নগর ইউনিয়নের চুনিয়াপাড়া গ্রামের হতদরিদ্র রিকশা চালকের ছেলে মো. জিল্লুর রহমান শিক্ষায় ও পানাগর ইউনিয়নের গুনাজিপাড়ার সনাতন ধর্মের হতদরিদ্র গরুর রাখাল সন্তোষচন্দ্র মন্ডলের কন্যা রত্নারানী মন্ডল (ভ্যাটেরিনারি সার্জন) ক্যাডারে নিয়োগের জন্য সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। হতদরিদ্র পরিবারের সন্তানদের এমন সাফল্য হতদরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে আশার সঞ্চার ঘটবে বলে মন্তব্য করেছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সোহেল রানা।
হতদরিদ্র রিকশা চালক আকতার আলী'র সংসারে দুই সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান ৪১তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. জিল্লুর রহমান রাজশাহী বিশ্বদ্যিালয় থেকে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে অনার্স সহ মাস্টার্স শেষ করেছেন এবং ছোট কন্যাসন্তান জুলেখা খাতুন রাজশাহী কলেজে অর্থনীতি বিভাগে মাস্টার্স-এ অধ্যায়নরত রয়েছেন। অপরদিকে রাখাল সন্তোষ চন্দ্র মন্ডলের সংসারে দুই কন্যা। এরমধ্যে বড় কন্যা ৪১তম বিসিএস-এ (ভ্যাটেরিনারি সার্জন) ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত রত্নারানী মন্ডল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স সহ মাস্টার্স শেষ করেছেন এবং ছোট মেয়ে রাখিরানী মন্ডল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে জেনেটিক্স এ- ব্রিডিং বিষয়ে অনার্স সহ সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন।
৪১তম বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নিয়োগে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. জিল্লুর রহমানের পিতা চুনিয়াপাড়া গ্রামের রিকশা চালক আকতার আলীর সহায় সম্বল বলতে মাত্র আড়াই শতাংশ জমির ওপরে টিনের ছাউনির দুইখান ঘর। আর রাখাল সন্তোষ সে জমিতে টিনের ছাউনির একটা বেড়ার বাড়ীটিই একমাত্র সহায় সম্ভব রিকশা চালক আকতার আলীর। অপরদিকে বিসিএস-এ (ভ্যাটেরিনারি সার্জন) ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত রত্নারানী মন্ডলের পিতা সন্তোষ চন্দ্র মন্ডলের সম্বল বলতে টিনের চালার তৈরী একটি বাড়ী ও ৩টি দুধের গরু।
মো. জিল্লুর রহমানের পিতা রিবশা চালক আকতার আলী বলেন, টিনের চালার বাড়ীটি ছাড়া আর কিছুই নেই আমার। দুই সন্তানের পড়ালেখা ও পরিবারের খরচ চালাতে নিজগ্রামে কৃষিশ্রমিক ও দিনমজুরি করতেন তিনি। বড় সন্তান মো. জিল্লুর রহমান হাটকানপাড়া ডিগ্রী কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করলে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য শহরে কোচিংএ ভর্তি করান। শহরে প্রতিদিন কোচিংয়ে যাতায়াত খরচ চালাতে কষ্টসাধ্য হয়ে উঠলে রাজশাহী শহরে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে পরিবার নিয়ে চলে যান আকতার আলী।
সেখানে মহাজনদের কাছ থেকে ভাড়ায় রিকশা নিয়ে দিনরাত রিকশা চালিয়ে ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচ সহ পরিবার চালাতেন আকতার আলী। মেধাবী জিল্লুর রহমান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে সে পড়ালেখার পাশাপাশি বাবাকে পরিবারের খরচে সহযোগীতা করতে টিউশনি শুরু করেন। ২০১৭ সালে মাষ্টার্স শেষ হলে তিনি সরকারী চাকরীর জন্য আবেদন করার পাশাপাশি বিসিএসের জন্য নিয়মিত পড়াশুনা চালিয়েছেন।
মো. জিল্লুর রহমান ২০২৩ সনের জানুয়ারীতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগ পেলে দুর্গাপুর উপজেলা শ্রীধরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জানুয়ারী মাসে যোগদান করেন। এরপর বিসিএস পরীক্ষায় অংশনিলে ৪১তম বিসিএসের চুড়ান্ত পরীক্ষায় (শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হন।
হতদরিদ্র রিকশা চালক পিতা আকতার আলী ছেলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় আনন্দ ও খুশির অনূভুতি প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন, আজ আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পেছনে গ্রাম ও এলাকাবাসীর অবদান সবচেয়ে বেশী। এর কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, আমার ছেলে জিল্লুর রহমান যখন মাধ্যমিকে পড়াশোনা করে তখন ছেলের পড়াশোনার জন্য গ্রামের ও এলাকার বৃত্তবানরা অ্রথনৈতিকভাবে সহযোগীতা করেছেন। আমি পেশায় একজন রিকশা চালক। আড়াই শতাংশ বাড়ীর জমি ছাড়া আমার কিছুই নেই। ছেলে মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালাতে ১৫ বছর ধরে রাজশাহী শহরে রিকশা চালান তিনি।
তিনি বলেন, রিকশা চালিয়ে আমি সন্তানকে দেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করিয়েছি। এবং আমার কষ্টের অর্জন হিসেবে আজ আমার ছেলে বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় আমি সবচেয়ে খুশি ও আনন্দিত। ছেলে বিসিএস ক্যাডার হয়েছে তেমনি মেয়েটাও বিসিএস ক্যাডার হবে এটাই আমার একমাত্র স্বপ্ন। বিসিএস (শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মো. জিল্লুর রহমান বলেন, আমি হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান। আমার বাবা রিকশা চালিয়ে আমাকে বিসিএস ক্যাডার বানিয়েছে এটা আমার গর্ব।
অপরদিকে ৪১তম বিসিএস ভ্যাটেরিনারি সার্জন) ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশপ্রাপ্ত রত্নারানী মন্ডলের পিতা গুনাজিপাড়া গ্রামের গরুর রাখাল সন্তোষ চন্দ্র মন্ডল তার পিতার রেখে যাওয়া পৌনে দুই বিঘা জমি’র মধ্যে বাড়ীর ভিটার ৮ শতাংশ জমি বাদে সব জমি বিক্রি করে দুই মেয়ের পড়ালেখার খরচ চালিয়েছেন াার জমি বিক্রির টাকার মধ্যে কিছু টাকা দিয়ে দূধের একটি গাভী কিনেছিলেন। সেই গাভী থেকে এখন তিনটি গাভী লালন পালন করেন। আর গাভীর দূধ বিক্রি করে সংসার চালান।
প্রতিবেশী ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড এর সদস্য সচিব বিধান সরকার জানান, বর্তমানে তিনটি দূধের গাভীই সম্বল সন্তোষ চন্দ্র মন্ডলের। নিজেই রাখাল হয়ে গরু লালন পালন করেন তিনি। দরিদ্র রাখাল বাবার পরিবারে যেন গবরে পদ্ম ফুল ফুটেছে এমনি মন্তব্য করছেন পুরো এলাকাবাসী।
বিধান সরকার আরো বলেন, গত ২০২৩ সালের জানুয়ারীতে সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষিকা পদে নিয়োগ পান রত্নারানী মন্ডল। সে দুর্গাপুর উপজেলার গোলাবাড়ী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বিদ্যালয়ে কর্মরত অবস্থায় তিনি ৪১ তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পরীক্ষায় (ভেটেরিনারি সার্জন) ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
কন্যা রত্নারানী মন্ডল বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় দরিদ্র রাখাল পিতার সন্তোষ চন্দ্র আনন্দ ও খুশির অনূভুতি প্রকাশ করতে গিয়ে আবেগআপ্পুত কন্ঠে বলেন, পেশায় আমি একজন গরুর রাখাল হলেও আজ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সফল বাবা। আমি আজ অনেক খুশি ও আনন্দিত। আমি দরিদ্র হওয়া সত্বেও সন্তানদের প্রতি আমি দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করতে পেরেছি বিধায় আমার সন্তানের এই সফলতা।
বিসিএস ক্যাডার রত্নারানী মন্ডল বলেন, আমার পরিবার দরিদ্র হওয়া সত্বেও আমার বাবা মায়ের অনুপ্রেরনায় আজ আমি সফল হয়েছি। আমি আজ গর্বিত গরুর রাখালের মেয়ে বিসিএস ক্যাডার। ইচ্ছাশক্তি ও নিয়মিত অধ্যায়বসায় আমার সফলতার মূল চাবিকাঠি।
এদিকে হতদরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা দুই মেধাবী বিসিএস ক্যাডারের ্অভাবনীয় কৃতিত্বের এই সাফল্যে দেশের হতদরিদ্র পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা জিল্লুর রহমান ও রত্নারানী মন্ডলকে অনূকরন করে সামনের দিকে অগ্রসর হবে। রিকশা চালক ও গরুর রাখালের সন্তান হয়েও দেশের সর্ব্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করে বিসিএস ক্যাডার হওয়ায় শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. সোহেল রানা, সহকারী কমিশনার (ভূমি) কৃঞ্চ চন্দ্র, দুর্গাপুর থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নাজমুল হক, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, সাংবাদিক সমাজ, রক্তযোদ্ধা ফাউন্ডেশন সহ বিভিন্ন মহল।