বছরে প্রায় ৩২ কোটি ১২ লাখ টাকার লোকসানে চলছে রাজশাহী সুগার মিলস্। কর্তৃপক্ষ বলছেন, এক কেজি চিনি উৎপাদনে ৪০৫ টাকা ৬৮ পয়সা খরচ হলেও বিক্রি হচ্ছে কেজি প্রতি মাত্র ১০০ টাকায়। এছাড়াও আখচাষে কৃষকদের ভূর্তকি প্রদান, আখ সঙ্কট, জমির স্বল্পতা ও উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি হচ্ছে এই লোকসানের মূল কারণ। যে কারণে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতা প্রদানসহ বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত হয়ে রাজশাহী সুগার মিলস এখন অনেকটায় চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট ১৬টি চিনিকল রয়েছে। কিন্তু ক্রমাগত লোকসানের কারণে ২০২০ সালে সরকার ছয়টি সুগার মিলস বন্ধ করেছে। কিন্তু তৎকালীন সময়ে রাজশাহী সুগার মিলস চিনি উৎপাদনে ২য় অবস্থানে থাকায় বাতিলের খাতা থেকে বাদ যায় এই প্রতিষ্ঠানের নাম। তারপরেও সে সময় রাজশাহী সুগার মিলসও বন্ধ হয়ে যাবে এমন গুঞ্জনে এখানকার চাষীদের জন্য বরাদ্দকৃত সরবরাহের সার, বীজ, কীটনাশক সহ অন্যান্য কৃষিজাত উপকরণগুলো অন্য সুগার মিলসে প্রেরণ করা হয়। এতে স্থানীয় আখ চাষীরা হতাশ হয়ে তাদের আখ চাষের জমি থেকে মুড়ি আখ (গোড়ার আখ গাছ) তুলে ফেলে। অধিকাংশ কৃষকই তাদের জমিতে আখের বদলে অন্যান্য ফসল চাষে ঝোঁকে। আবার অনেকেই চাষযোগ্য জমি কেটে পুকুর খনন করতে থাকে। এর ফলে বিরূপ প্রভাব পড়ে রাজশাহী সুগার মিলের উপর। আর আখ সঙ্কটের কারণে গত তিন বছরে চিনির উৎপাদন কমেছে তিন-চতুর্থাংশ।
গত পাঁচ বছরের উৎপাদন সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭-১৮ আখ মাড়াই মৌসুমে প্রতিষ্ঠানটিতে ৯৩ হাজার ৯৪ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয়েছে। এতে চিনির উৎপাদন হয়েছে ৫ হাজার ৪৪৮ মেট্রিক টন। তবে পরের বছর ২০১৮-১৯ আখ মাড়াই মৌসুমে আখের উৎপাদন বৃদ্ধি হওয়ায় মাড়াই হয় ১ লক্ষ ২ হাজার ৫২৫ মেট্রিক টন। যা থেকে ৬ হাজার ২১২ মেট্রিক টন চিনি উৎপাদন হয়। এর পরের বছর ২০১৯-২০ মৌসুমে আখের উৎপাদন আরো বৃদ্ধি হওয়ায় আখ মাড়াই হয় ১ লক্ষ ২৯ হাজার ২৫২ মেট্রিক টন। যা পূর্বের তুলনায় ২৬ হাজার ৭২৬ মেট্রিক টন বেশি। ফলে মৌসুমটিতে চিনি উৎপাদন বেড়ে দাঁড়ায় ৮ হাজার ১৯ মেট্রিক টন। এরপর হঠাৎ করেই সুগার মিলস বন্ধ হয়ে যাবে এমন গুঞ্জনে আখ চাষের পরিমাণ কমে যায়। ফলে ২০২০-২১ মৌসুমে আখ মাড়াই হয় ৬৩ হাজার ৯৬৪ মেট্রিক টন। যা থেকে চিনির উৎপাদন হয় ৩ হাজার ৬৬৪ দশমিক ৬০ মেট্রিক টন। পরের মৌসুমে অর্থাৎ ২০২১-২২ মৌসুমে আখের উৎপাদন আরো কমে যাওয়ায় ২৪ হাজার ৩ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয় এবং তা থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ৩০৮ মেট্রিক টন। বর্তমানে চিনির মজুদ রয়েছে ১ হাজার ১৯ মেট্রিক টন। চলতি মৌসুমে (২০২২-২৩) ২৬ হাজার ৪৫ মেট্রিক টন আখ মাড়াই হয় এবং তা থেকে চিনি উৎপাদন হয় মাত্র ১ হাজার ৩৫৬ মেট্রিক টন। তবে গত বছরের চেয়ে এবছর দুই হাজার ৪২ মেট্রিক টন আখ বেশি উৎপাদন হয়েছে।
এদিকে রাজশাহী সুগার মিলসের চিনির চাহিদা প্রচুর যা বলার মতো নয়। বাজারের প্যাকেটজাতের তুলনায় রাজশাহী সুগার মিলসের উৎপাদিত চিনির গুণ ও মান সবসময়ই শীর্ষস্থানে। কিন্তু উৎপাদন স্বল্পতার কারণে চাহিদা থাকা সত্ত্বেও সব চিনি খোলা বাজারজাতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। যে কারণে এখানকার উৎপাদিত চিনি আপাতত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ বাহিনীকে সরবরাহ করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে রাজশাহী সুগার মিলস্ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল বাশার বলেন, সরকারি এসব দপ্তরের চাহিদা মিটিয়ে অল্পকিছু চিনি আমাদের কিছু ডিলারদের দেওয়া হয়। আর এসব বরাদ্দ আসে শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে। যেসব বরাদ্দের স্লিপ দেখে চিনি প্রদান করা হয়। তিনি বলেন, কৃষি প্রণোদনা হিসেবে আখ চাষীরা সার, কীটনাশক ও এসটিটি পদ্ধতিতে আখ আবাদের জন্য আখের মুড়ির জন্য চাষীরা ভূর্তুকি পেয়ে থাকেন। তারপরও আখের আবাদ-উৎপাদন কম ব্যাখায় ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ২০২০ সালের প্রথমদিকে চাষীরা জানতে পারে রাজশাহী সুগার মিলস বন্ধ হয়ে যাবে। এরপর থেকে চাষীরা আখচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। আবার আমরা আখচাষীদের কাছে থেকে ১৮০ টাকা মূল্যে আখ ক্রয় করি। কিন্তু তারা গুড় ব্যবসায়ীদের কাছে আমাদের চেয়েও আরো বেশি দামে আখ বিক্রি করেন। যার পরিমাণ আড়াই থেকে তিনশ’ টাকা। আবার চাষীদের কাছে থেকে সংগ্রহকৃত আখের মূল্যও আমরা সময়মতো পরিষোধ করতে পারি না। তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা আমাদের চেয়ে বাইরে আখ বিক্রি করতে পছন্দ করে। এসব কারণে আমরা আখ সঙ্কটে পড়ি। তবে সম্প্রতি সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ১৮০ টাকার স্থলে ২২০ টাকায় চাষীদের কাছে থেকে আখ ক্রয় করার। এটি ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়াবে ২৪০ টাকায়।
আখচাষের জমির পরিমাণ কমার কারণ হিসেবে এমডি আবুল বাশার জানান, সুগারমিলসের আশপাশে বেশ কয়েকটি ইটভাটা হয়েছে। এছাড়াও প্রচুর পরিমাণ পুকুর খনন করে মাছ চাষ হচ্ছে। আখে থেকে চাষীরা মুনাফা না পাওয়ায় অন্যান্য লাভজনক চাষে ঝুঁকছেন চাষীরা। আবার আখের মূল্য বৃদ্ধি, শহর বা নগরায়নের প্রভাব এবং সার-কীটনাশক সহ অন্যান্য পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে বহুলাংশে আখ চাষ কমেছে।
রাজশাহী জেলার পবা উপজেলার হরিয়ান ইউনিয়নে অবস্থিত চিনি কলটির জমির পরিমান ২২৯ দশমিক ৫৭৫ একর। এর মধ্যে ১০০ একরের মধ্যে রয়েছে মিল ক্যাম্পাস অর্থাৎ আবাসিক কলোনি, স্কুল, স্কুল মাঠ, মসজিদ, মেডিকেল, কারখানা, গেষ্ট হাউজ, গাড়ী পার্কিং গ্যারেজ, প্রশাসনিক ভবন, জৈব সার কারখানা, রাস্তা-ঘাট ও সাব-জোন। আর ১১০ একর জমিতে রয়েছে পরীক্ষামূলক খামার এবং বাকি প্রায় ২০ একর জায়গাজুড়ে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র। রাজশাহী সুগার মিলসে বর্তমানে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছে ৪৫ জন ও বাকি ৬৪৮ জন কর্মচারী-শ্রমিক রয়েছে (স্থায়ী ও অস্থায়ী মিলে)। এই চিনি কলের রয়েছে মোট ৯টি সাবজোন। এর মধ্যে পশ্চিমে কাশিয়াডাঙ্গা, নওদাপাড়া, মিলস গেট-ক ও মিলস গেট-খ জোনে উৎপাদন একেবারেই স্বল্প। কারণ এসব অঞ্চলে অতিরিক্ত নগরায়ন হওয়ায় আখের চাষযোগ্য জমি দিনে দিনে কমেই যাচ্ছে। এর ফলে উৎপাদনও কম। অন্যদিকে পুঠিয়া, নন্দনগাছী, সরদহ, চারঘাট ও আড়ানীতে উৎপাদন বেশ ভালো। সেক্ষেত্রে মিলের মোট চাহিদা এ ৫টি সাবজোন থেকেই পুরণ করা হয়।
মিলটির ইতিহাস ঘেটে জানা গেছে, এটি ১৯৬২ সালে এ শিল্প প্রতিষ্ঠানটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯৬৫ সালে সমাপ্ত হয়। পরে ১৯৬৫-৬৬ সাল থেকে এটিতে চিনির উৎপাদন শুরু হয়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রয়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে। চিনি উৎপাদনে রাজশাহী সুগারমিলস বর্তমানে ৮ম অবস্থানে রয়েছে।
রাজশাহীর পুঠিয়া উপজেলার আখচাষী মো. আবদুল মান্নান সরকার বলেন, দীর্ঘদিন ধরে আখচাষ করে আসলেও বিভিন্ন কারণে এই ফসল উৎপাদনে এখন তিনি আগ্রহ হারিয়েছেন। এর কারণ হিসেবে বলেন, আখ চাষ উৎপাদনে প্রায় পুরো বছরই চলে যায়। আখ চাষ করলে ওই জমিতে একাধিক ফসল সেভাবে করার সুযোগ থাকেনা। এছাড়াও দিন-দিন সার, বীজ, কীটনাশক সহ লেবার খরচ বাড়ছে। জমি থেকে আখ কেটে সুগারমিল পর্যন্ত পৌছে দিতে যে গাড়ী ভাড়া লাগতো, সেটিও বেড়েছে। কিন্তু খরচ বাড়লেও তুলানামূলক বাড়েনি আখের দাম। তাছাড়া সরকার যে ভূর্তকি দেয় তা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত না। আমরা আখ চাষ না করলে মিলও অচল হয়ে যাবে। তাই সরকারের উচিত আখের মূল্য বৃদ্ধি করা এবং আমাদের প্রয়োজনীয় কৃষি সহায়তা দেওয়া।
রাজশাহী সুগারমিলসের বর্তমানের অচলবস্থার বিষয়ে জানতে চাইলে অপর চাষী তরিকুল সরকার বলেন, আখ সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে কৃষকদের উন্নত প্রশিক্ষণ, আখের বীজ প্রদানসহ আখের মূল্যবৃদ্ধি জরুরী। এছাড়াও স্থানীয় সরকার ও জনপ্রশাসনকে চাষযোগ্য জমি রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। তবেই আমরা রাজশাহীর এ ঐতিহ্যবাহী শিল্প-কারখানাটিকে বন্ধের হাত থেকে বাঁচাতে পারি। অন্যদিকে প্রতিষ্ঠানটিতে সম্ভাবনা বা উন্নয়নের ব্যাপারে জানতে চাইলে রাজশাহী সুগার মিলস্ ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবুল বাশার বলেন, আখ স্বল্পতার কারণে এই চিনি কলটি বছরের অর্ধেকেরও কম সময় চালু থাকে। বাকি সময় মিল বন্ধ থাকে (মাড়াই কাজ)। ওই সময় আমরা সুগারমিলসে অন্যান্য সহযোগী পণ্য উৎপাদন ও বিপণন করতে পারি যেমন- মাংগো জুস, ডিস্টিলারি স্থাপন কিংবা কো-জেনারেশনের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন। যেহেতু আমাদের জায়গা, শ্রমিক ও সময় সবই আছে সেহেতু এই প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে আমাদের তরফ থেকে সরকারকে এসব প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি চায়নারা এসে প্রতিষ্ঠানটি পর্যবেক্ষণ করে গেছেন। তবে এসব বিষয়গুলো প্রাধান্য পাবে কি না তা নির্ভর করছে সরকার সিদ্ধান্তের ওপর।