কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী পৌরসভার মালভাঙ্গা মলাতিটারী এলাকার মৃত কাছিম উদ্দিনের ছেলে নুর জামাল মিয়া একজন দিনমজুর। দনিমজুরের আয়ে চলে তার সংসার। পাশাপশি ধার-দেনা করে বাড়িতে গড়ে তুলেছেন ৫টি গরু গরু দিয়ে ছোট্ট খামার। এই ৫টির মধ্যে একটি গরু অন্যের থেকে আধিযারি নিয়েছেন। ইচ্ছে ছিলো সেই গুরু প্রতিপালন করে বিক্রি করে মেয়েকে বিয়ে দেয়া আর ধারদেনা পরিশোধ করার ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু গেলো ঈদের পরে পরপর ৩টি গরুই ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। স্থানীয় প্রাণি সম্পদ অফিসের উপণ্ডসহকারী অফিসার হারুনউর রশিদ এসব গরুর চিকিৎসা করেও বাঁচাতে পারেনি গরুকে। বরং উল্টো এসব গরুর চিকিৎসায় তার খরচ হয়েছে ১১হাজার টাকা। তার এই গরু হারিয়ে এখন অনেকটা নিঃস্ব অবস্থা তার। আরও অধিকহারে ঋণের বৃত্তে আটকে যাবার শঙ্কায় তিনি। একই অবস্থা এ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায়। ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়েছে গরুর ল্যাম্পি স্কিন ডিজিজ বা এলএসডি নামের ভাইরাসজনিত রোগের সংক্রমণ। প্রতিনিয়ত নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন গরু-বাছুর। প্রথমে জ্বর জ্বর ভাব, পরে গোটা গোটা হয়ে ক্ষতের সৃষ্টি হচ্ছে গরুর শরিরে। এরপর খসে খসে পড়ছে আক্রান্ত স্থানের চামড়া ও মাংসপিন্ড। সঠিক চিকিৎসার অভাবে মারাও যাচ্ছে কৃষকদের স্বপ্নের সম্পদ। গরুর চামড়ার ক্ষতিকর ভাইরাসের আক্রমণে ব্যাপক লোকসানের আশঙ্কায় দিশাহারা হয়ে পড়ছে প্রান্তিক খামারী ও কৃষকরা। কৃষকদের অভিযোগ বারবার প্রাণি সম্পদ অফিসে যোগাযোগ করেও দেখা মেলে না কর্মকর্তা কর্মচারীদের। আর প্রাণি সম্পদ দপ্তরের দাবি নিয়মিত মনিটরিং এর মাধ্যমে চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন তারা।
খামারি ও সংশ্লিষ্টরা জানান, হঠাৎ গরুর গা গরম হয়ে জ্বর ওঠে। শরীরজুড়ে ছোট ছোট মাংসপিন্ডের মতো ফুলে উঠছে। অনেকটা আঁচিলের মতো। পা, ঘাড়, মাথায় এসব বেশি উঠছে। চামড়া উঠে ক্ষতে পরিণত হচ্ছে। গরু এ সময় খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে। সব ধরনের গরুই আক্রান্ত হচ্ছে এই রোগে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে বাছুর।
চিকিৎসকদের মতে, আক্রান্ত গবাদি পশুর চোখ দিয়ে পানি ঝরে চোখ অন্ধ হয়েও যেতে পারে। ষাঁড় গরুর ক্ষেত্রে ইনফার্টিলিটি এবং গর্ভবতী প্রাণিতে গর্ভপাত ঘটে। ক্ষুরা রোগের চেয়েও বেশি ভয়ঙ্কর এ রোগটি সাধারণত বর্ষার শেষে, শরতের শুরুতে বা বসন্তে মশা-মাছির বিস্তারের সময় ব্যাপক আকারে দেখা দেয়। মশা-মাছির এবং খাবারের মাধ্যমে এক গরু থেকে অন্য গরুতে ভাইরাসজনিত এ রোগ ছড়ায়। ভ্যাক্সিন দিয়ে আক্রান্ত থেকে রক্ষা এবং আক্রান্ত হওয়ার পর আক্রান্ত গরু আলাদা ও মশারির ভেতর রাখা জরুরি। এ রোগে আক্রান্ত গরু নিয়ে প্রতিদিনই উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালে ভিড় করছেন খামারী ও কৃষকরা।
নাগেশ্বরী পৌরসভার মালভাঙ্গা মলাতিটারী এলাকায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে ওই এলাকায় এ পর্যন্ত ১০টি গরু মারা গেছে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে। এদের অধিকাংশই দিনমজুর। অনেকেই গরু ছাগল লালন পালন করে চালান সংসার। অথচ তাদের এই স্বপ্নের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে সুচিকিৎসার অভাবে। একই এলাকার তদারক আলীর স্ত্রী পারভিন বেগম জানায় তাদের আড়াই বছরের পিতৃহীন নাতনীকে একটি গরু উপহার দিয়েছিলেন তারা। সে গরুটিও মারা গেছে সঠিক চিকিৎসার অভাবে। নয়া মিয়ার স্ত্রী শেফালী বেগম জানায় গরু পালন করে সে টাকায় তাদের ছেলে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালান তারা। তাদের ৩টি গরুই আক্রান্ত হয়েছে। এগুলোর অবস্থা আসঙ্কাজনক। কৃষক মোবারক আলীরও ৩টি গরুর মধ্যে দুইটির অবস্থা আসঙ্কাজনক। রায়গঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারভিটা এলাকার পিলপিলি বেগম জানায় তাদের একটি গরু মারা গেছে এই রোগে। এদিকে বেরুবাড়ী ইউনিয়নের ওয়াপদাবাজার এলাকার রোকনুজ্জমান বুলু জানায় তার ১টি গরু আক্রান্ত হলে উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসে কয়েক বার নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছেন। তবে এ চিকিৎসায় ব্যর্থ হয় প্রাণিসম্পদ অফিস। শেষপর্যন্ত সে গরুটিও মারা যায়। উপজেলার সন্তোষপুর ইউনিয়নের তালেবেরহাট, শিয়ালকান্দা, রায়গঞ্জের সাপখাওয়া, মোল্লারভিটা, মিনাবাজার, বড়বাড়ী, পৌরসভার মধুরহাইল্যা, বলদিটারী, সাঞ্জুয়ারভিটা, বানিয়াটারীসহ উপজেলার প্রায় প্রতিটি গ্রামেই প্রকট আকার ধারণ করেছে এই রোগের সংক্রমন। উপজেলা প্রাণি সম্পদ দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এ উপজেলায় প্রান্তিক খামারীসহ প্রায় ৯ হাজার খামারী রয়েছে আর এতে গবাদিপশুর সংখ্যা ১ লাখ ৪৯ হাজার ১৩৯টি।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ অফিসের ভেটেরিনারী সার্জন ডা. আশিকুজ্জামান বলেন, উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তরের পক্ষ থেকে আমাদের ভ্যাকসিনেশন ক্যাম্প কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছি এবং আমাদের যা স্টক আছে সেটুকু প্রান্তিক পর্যায়ে খামারীদেরকে ভ্যাকসিন পৌছে দিচ্ছি এবং খামারীদেরকে সচেতন করার জন্য নিয়মিত উঠান বৈঠক, ফ্রি ভেটেরিনারী ক্যাম্প ও পল্লী চিকিৎসকরা যাতে এ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ না করে সে ব্যাপারে পরামর্শসহ বিভিন্ন সচেতনতা মুলক কার্যক্রম চলমান রেখেছি।