বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর লোকজন চরম অবহেলার শিকার। সরকার ২০১৩ সালে হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি ও ভোটাধিকার দেন। কিন্তু তারপরও সমাজে তাদের অবস্থানের তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সমাজে তারা প্রতিনিয়ত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হয়। নিজ পরিবারেও তারা অচ্ছুত ও অনাদৃত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, হিজড়ারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সরকার প্রদত্ত হিজড়াপল্লীতে বসবাস করে অথবা নিজেদের উদ্যোগে ভাড়াকৃতভাবে তৈরিকৃত কোন আবাসস্থলে। আবার অনেক সময় এও দেখা যায়, বাড়িওয়ালারা সহজে হিজড়াদের বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। তাই, স্বাভাবিকভাবে যে সকল জায়গা ভাড়ার অনুপযুক্ত সেই সকল নোংরা পরিবেশে মাথা গোজার ঠাঁই হয় হিজড়া সম্প্রদায়ে। এমনকি বাংলাদেশের উত্তরাধিকার আইন এখনো নারী-পুরুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে তারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হতে পারে না। বেশির ভাগ হিজড়াই কোনো সম্মানজনক জীবিকায় নেই, ভিক্ষা ও চাঁদাবাজিই তাদের মূল পেশা। কেউ কেউ আবার যৌনকর্মকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশে হিজড়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা নিয়ে সঠিক কোনো তথ্যও নেই। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। অন্য একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপমতে এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি। রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজড়াদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত এবং নাগরিকত্বের সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার বাধা দূর হলেও হিজড়াদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিচারের ব্যবস্থা নেই। যদিও হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে যৌন নির্যাতন ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন। এ ছাড়া কিছু বিকৃত রুচির পুরুষ তাদের বিকৃত যৌনকামনা পূরণ করতে অনেককেই বাধ্য করে থাকেন। কিন্তু আইনি প্রতিকারের পথ না থাকায় ও লোকলজ্জার কারণে হিজড়ারা সবকিছু নীরবে সয়ে যান। কেননা হিজড়াদের যৌন নির্যাতন করা হলে সেটি ধর্ষণ নাকি বলাৎকার সে বিষয়েও কারও কোনো ধারণা নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নারী ও শিশুদের প্রতি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করবেন, কার কাছে বিচার চাইবেন তা নিয়ে কোনো আইনেই কিছু বলা নেই। তাই হিজড়াদের ওপর যৌন হয়রানি ও নির্যাতনের প্রতিকারের বিষয়টি ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে’ অন্তর্ভুক্ত করা। হিজড়া সম্প্রদায়ের বড় অংশই শিক্ষার অধিকার থেকে যেমন বঞ্চিত তেমনি মানবিক ও মৌলিক অধিকার পেতেও অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। যেহেতু তাদের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। তাই তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পর এমন মানবেতর পরিস্থিতি থেকে হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সরকারকে অবশ্যই আরও দায়িত্ব নিতে হবে। হিজড়াদের জন্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। নইলে হিজড়াদের প্রতি প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বদল কিংবা তাদের প্রতি মানবিক আচরণ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। তাই তাদের সংশোধন হতে আগ্রহী করতে হবে। তাহলে হিজড়া সম্প্রদায়কে সমাজের মূলস্রােতে নিয়ে আসা সহজ হবে। পাশাপাশি সরকারকে হিজড়াদের ওপর যৌননির্যাতন বন্ধে আইনি প্রতিকার নিশ্চিত করতে হবে।