খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার ভৈরব নদীর নগরঘাট- রেলীগেট অংশের ওপর নির্মিত ভৈরব সেতুর নির্মাণ কাজ নানা জটিলতার কারণে চলছে ঢিলেঢালা গতিতে।
এলাকাবাসী ও সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা যায়, সেতুটির নির্মাণ কাজ সমাপ্তির তারিখ ২০২২ সালে পার হলেও সেতুটির নির্মাণ কাজ হয়েছিল মাত্র ৪ শতাংশ। সেতুর ৩০টি পিলারের মধ্যে মাত্র ৩টি পিলারের কাজ সমাপ্তির পর কাজের ক্ষেত্র না থাকায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ভৈরব সেতুর দিঘলিয়া অংশের ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর সেতু নির্মাণ কাজ পরিচালনায় নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) সেতুটি নির্মাণের কার্যাদেশ পেলেও ত্রিমুখি বাস্তব সমস্যার কারণে কাজ বেশীদূর এগোতে পারেনি। ২০২২ সালের ২৪ মে ভৈরব নদীর পূর্ব পারে দেয়াড়া আর ডি এন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠের সরকারি জায়গার উপর সেতুর ২৫ নং পিলারের কাজের মাধ্যমে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। পরবর্তীতে ওই সরকারি জমির উপর সেতুর ২৪ নং পিলারও কাজ শেষ করা হয়। পরবর্তীতে সেতুর খুলনা শহরাংশের সরকারি জমির উপর ১৪ নং পিলারের কাজ শেষ করে বন্ধ হয়ে যায় সেতুর নির্মাণ কাজ। সব মিলিয়ে তখন সেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতি ছিল শতকরা ৪ শতাংশ। যদিও সেতু বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের মতে আরও অনেক বেশী। ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া ও আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়াও সেতুর নির্মাণ কাজের অগ্রগতির আংশ। উল্লেখ্য, খুলনার এ ভৈরব নদীর উপর নির্মাণাধীন ভৈরব সেতু বাস্তবায়ন করছে খুলনা সড়ক ও জনপথ বিভাগ (সওজ)।
সম্প্রতি সেতুর পূর্বাংশ দিঘলিয়ার সেতু নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত ব্যক্তি মালিকানাধীন জমির ভূমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া শেষ হলেও জমির স্থাপনা ও গাছ-পালা সেতু বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ খুলনা সড়ক ও জনপথ (সওজ) নিলাম দিলেও অপসারণ প্রক্রিয়া শেষ হয়নি। পাশাপাশি সেতু নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য কম থাকলেও সেতুর নির্মাণ কাজ পরচালনার তিন জটিল সমস্যার কারণে নির্মাণ ব্যাহত হয়। সেতুর নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত দিঘলিয়া অংশের সমস্যার সমাধান শেষ হলেও সেতুর পশ্চিমাংশ দৌলতপুর কুলিবাগান থেকে রেলিগেট পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানা ও রেলওয়ের জায়গা অধিগ্রহণ প্রক্রিয়ার এখনও সমাপ্তি ঘটেনি। পাশাপাশি ওজোপাডিকোর সেতু নির্মাণ এলাকার বিদ্যুতের খুঁটি অপসারণ করা হয়নি। সব মিলিয়ে সেতুটি নির্মাণের জটিল সমস্যাগুলোর পুরোপুরি সমাধান এখনও সুদূরপ্রসারী। যা আগামী দিনগুলোতে সেতুর নির্মাণ কাজ পুনরায় ব্যাহত করতে পারে। সাথে রয়েছে সেতুর নির্মাণ কাজ পরিচালনায় ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ ( করিম গ্রুপ) এর ক্ষয়-ক্ষতি। কারণ হিসেবে জানা গেছে, ঠিকাদার সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করার সময় সেতুর নির্মাণ কাজে ব্যবহৃত মালামালের মূল্য কম ছিল। এখন নির্মাণ সামগ্রীর মূল্য অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি রয়েছে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনভাতা ও আবাসন খরচ।
প্রকল্প কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ২০১৯ সালের ১৭ ডিসেম্বর ভৈরব সেতু নামে প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পায়। এরপর ২০২০ সালের ২৭ জুলাই সওজ ‘র খুলনা জোনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ভৈরব নদীর উপর সেতু নির্মাণ কাজের দরপত্র আহ্বান করেন। প্রক্রিয়া শেষে ২০২০ সালের ১২ নভেম্বর ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশন লিঃ (করিম গ্রুপ) নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে সেতুর নির্মাণকাজ দেওয়ার বিষয়ে অনুমোদন দেওয়া হয়। এর ১৩ দিন পর ২০২০ সালের ২৬ নভেম্বর জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কার্যাদেশ পাওয়ার ৬ মাস পর ২০২১ সালের ২৪ মে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে সরকারি খাস জমির উপর ২৪ নং পিলারের টেস্ট পাইলিং এর মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে ভৈরব সেতুর নির্মাণ কর্মযজ্ঞ। এখন পর্যন্ত এ সেতুটির নির্মাণ কাজের অগ্রগতি শতকরা ৬ শতাংশ। সেতুটি নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের দাবী কাজের অগ্রগতি অনেক।
উল্লেখ্য, ভৈরব সেতুর পিলার বসবে মোট ৩০ টি। এর মাধ্যমে সেতুর শহরাংশে কুলিবাগান হতে রেলিগেট ভৈরব নদীর তীর পর্যন্ত ১ থেকে ১৪ নং পিলার এবং সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে ১৭ থেকে ২৮ নং পিলার বসবে। সেতুর রেলিগেট প্রান্তে নদীর পাড় থেকে ৪২ মিটার ভেতরে ১৫ নং এবং সেতুর দিঘলিয়া প্রান্তে নদী পার হতে ১৮ মিটার ভেতরে ১৬ নং পিলার বসবে। এই দুই পিলারের উপর স্টিলের সেতু বসবে।
ইতোমধ্যে ৩টি পিলারের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়েছে। দুইটি পিলার বসানোর কাজ চলমান। সেতুর নির্মাণ কাজের প্রকল্প ম্যানেজার প্রকৌশলী এস এম নাজমুল হাসান এ প্রতিবেদককে জানান, সেতুর পূর্বাংশের জায়গা স্থাপনা ও গাছপালা মুক্ত হলে ২ মাসের মধ্যে পূর্বাংশের কাজ শেষ করা সম্ভব। কিন্তু সেতুর পূর্বাংশের জায়গা এখনও স্থাপনামুক্ত হয়নি।
প্রসঙ্গতঃ ভৈরব সেতুর মোট দৈর্ঘ্য হবে ১ দশমিক ৩১৬ কিলোমিটার। সেতু নির্মাণ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬১৭ কোটি ৫৩ লক্ষ টাকা। এরমধ্যে মূল সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০৩ কোটি টাকা। জমি অধিগ্রহণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮১ কোটি টাকা। বাকী টাকা সেতু সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কাজে ব্যয় ধরা হয়েছে। সামনে সেতুর নির্মাণকাজে ব্যবহৃত মালামালের উর্ধগতিসহ অন্যান্য কারণে ব্যয় বৃদ্ধিজনিত বাড়তি অর্থ ছারের প্রয়োজন হবে। এ অর্থ সংকটকে ঊহ্য রেখে সেতু নির্মাণের শুধু মহড়া চলছে, নির্মাণ কাজে গতি না আনা কর্তৃপক্ষের অর্থ সংকটকে আড়ালে রাখার কৌশল বলে অভিমত পেশ করেছেন এলাকার বিজ্ঞমহল।
দিঘলিয়ার নির্মাণাধীন ভৈরব সেতুর কর্মযজ্ঞ নিয়ে কথা হয় সেতুটির বাস্তবায়ন কর্মকর্তা খুলনা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ আনিসুজ্জামান মাসুদের সাথে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন সেতুর পূর্বাংশ দিঘলিয়ার জমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনা অপসারণ শেষ পর্যায়ে। গাছপালা ও বৈদ্যুতিক খুঁটিসহ আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলো যদি থাকে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করা হবে। তিনি শহরাংশের জমি ও বৈদ্যুতিক খুঁটি অপসারণের ব্যাপারে বলেন, ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ করার জন্য অর্থ খুলনা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জমা দেওয়া হয়েছে। রেলওেয়ের জায়গা হস্তান্তর প্রক্রিয়া খুব শিঘ্রই শেষ হবে। জায়গার সমস্যা সমাধানের সাথে সাথে বৈদ্যুতিক খুঁটিও অপসারণ করা হবে। তিনি বলেন খুলনার ভৈরব সেতুর নির্মাণকাজ পরিচালনায় আর কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে না। এ সেতু বাস্তবায়ন কাজে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স ওয়াহিদ কনস্ট্রাকশনের (করিম গ্রুপ) সেতু নির্মাণের কাজে ব্যবহৃত কাঁচামাল ও জনবল বৃদ্ধি করে কাজের গতি আনায়নের ব্যাপারটা আমি দেখবো। তিনি বলেন সেতুটি বাস্তবায়নে অর্থের কোনো ঘাটতি নেই। কাজের অগ্রগতি যত বাড়বে কাজের অনুকূলে সেই অর্থই পরিশোধ করা হবে।
এদিকে কাজের অগ্রগতি নিয়ে সেতু বাস্তবায়নের ব্যাপারে দিঘলিয়া উপজেলাবাসীর আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। তাদের জিজ্ঞাসা ২০২৪ সালের মধ্যে দিঘলিয়ার মানুষের বহুদিনের কাঙ্খিত স্বপ্নের সেতুর সফল বাস্তবায়ন হবেতো? না ভৈরব সেতু বাস্তবায়ন দিঘলিয়াসহ নড়াইল ও গোপালগঞ্জবাসীর স্বপ্ন শুধু প্রহসনই থেকে যাবে।