বিয়ে, জন্মদিন, পুজা অর্চনা কিংবা নানা আনন্দ আয়োজনে যারা বাদ্য বাজিয়ে অন্যকে আনন্দ দেন তাদের জীবনই দিন শেষে বিষাদের ছায়া। জীর্ণ-শীর্ণ কুঁড়ে ঘরে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে উৎকন্ঠার যাপিত জীবন। এমন ১৯টি ঢুলি পরিবার এখন পাকা বাড়ির মালিক। হয়েছে তাদের আপন ঠিকানা। এই ১৯টি ঢুলি পরিবারের আশ্রয় কেন্দ্র এখন কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের খিতাব খাঁ গ্রামে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, কুড়িগ্রামের রাজারহাট উপজেলার ঘড়িয়ালডাঙ্গা ইউনিয়নের ঢুলি আশ্রয় কেন্দ্রে গেলে দেখা মেলে ষাটোর্ধ বয়সের অনিল চন্দ্র বিশ্বাসের। যার একমাত্র পেশা বাদ্য বাজনা। প্রায় অর্ধশতক ধরে ঢাকের তালে নিজে দোলেন ও অন্যকে দোলান। তার পিতা বাজিয়েছেন, পিতামহ কিংবা দাদার দাদাও করেছেন একই কাজ। বংশ পরম্পরায় বাদ্য বাজিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন। শুধু অনিল চন্দ্র বিশ্বাসই নন; এই গ্রামের সকলেই বংশ পরম্পরায় বাজনা বাজিয়ে সংসার চালাচ্ছেন।
জানা যায়, বিয়ে, অন্ন প্রশাণ এবং দুর্গা পূজাসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পড়লেই তাদের ঢাকে কাঠি পড়ে, সানাইয়ে ওঠে সুরের লহরী। আর সেই আয়ে স্ত্রী-সন্তান ও পরিবারের হয় খাবারের সংস্থান। সামান্য আয়ের কারণে জীর্ণ-শীর্ণ বাসস্থানে মাথা গুঁেজ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। তবে এখন সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পণ্ড২ এর সহযোগিতায় ঘর পেয়ে কেটেছে ভয়-শংকা।
অনিল চন্দ্র বিশ্বাস বলেন, ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই বাদ্য বাজাই-ঢাক বাজাই। কোথাও অনুষ্ঠানে ডাক পড়লে যায়। যা আয় হয় তাদিয়ে সংসার চালানোটাই কঠিন সেখানে পাকাবাড়ি ছিল আমাদের স্বপ্নের মতন। সেই বাড়ি দিয়েছে দেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।
এ পল্লীর অমল, প্রদীপ, লক্ষ্মন, রনজিতসহ অনেকেই বলেন, আমরা যাই আনন্দের বাজনা বাজাতে। তখন বাড়িঘর ছেড়ে দুই-চারদিন থাকতে হয়। কিন্তু সেই অন্যকে আনন্দ দিলে শংকায় থাকতাম আমাদের পরিবারের লোকজন ঠিকঠাক আছে তো! কিন্তু এখন আর সেই দিন নাই। নতুন পাকা বাড়ি আমাদের জীবন বদলে দিয়েছে। এখন যতুটুক রোজগার করি না কেন তা নিয়ে অন্তত শান্তিতে ঘুমাতে পারছি। সেই সাথে গ্রামের মধ্যে পাকা মন্দিরও করে দিছে সরকার। এখন আমাদের ধর্মীয় কার্মকান্ডও এখানেই পরিচালিত হয়।
একই রকম আনন্দের কথা জানান, শান্তনা রাণীসহ একাধিক মহিলা। তারা বলেন- বাড়ির গার্জিয়ান যখন কাজে চলে যেত আমরা ভয়ে ভয়ে রাত পার করতাম। কিন্তু পাকা বাড়িতে এখন আর সেই কষ্ট নাই। সেই সাথে ছাগল, হাস-মুরগী পালনসহ শাক-সবজিরও চাষ করা সম্ভব হয়েছে। বাচ্চারা পাশের স্কুলে লেখা-পড়া সুযোগ পাইছে।
এ ব্যাপারে রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী অফিসার নূরে তাসনিম বলেন- এটি একটি ইউনিক প্রকল্প। কারণ এ রকম জনগোষ্টি যারা মানুষকে আনন্দ দেয়, মানুষের বিভিন্ন উৎসব আয়োজনে তাদের পারফর্মেন্সের মাধ্যমে অনুষ্ঠানকে সরব করে রাখেন। দিন শেষে তাদের থাকার জায়গাটি জরাজীর্ণ এবং অন্যের জায়গায় আশ্রিত হিসেবে থাকেন। তখন তাদের যে দুঃখ-দুর্দশা ছিল সেখান থেকে তাদের মুক্তি দেয়ার চেষ্টা এবং সাচ্ছন্দের জীবন পান সেই উদ্দেশ্য মাথায় রেখে এই প্রকল্পটি ডিজাইন করা হয়। সেখানে বর্তমানে ১৯টি পরিবার বসবাস করছেন। তাদের জীবনে স্বস্থির আবহ তৈরি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ জানান, জাতির পিতার বিখ্যাত উক্তি ‘কাউকে পিছনে ফেলে নয়, সবাইকে সাথে নিয়েই সামনে এগিয়ে যাওয়া’। সেই লক্ষ্যকে ধারণ করে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টিকেও এগিয়ে নেবার প্রচেষ্টা সদাসয় সরকারের রয়েছে। এরই আলোকে সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পণ্ড২ এর অধীনে কুড়িগ্রামের রাজারহাটের ঘড়িয়াল ডাঙার ১৯টি ঢুলি সম্প্রদায় পরিবারকে দেয়া হয়েছে পাকা বাড়ি। তাদের হয়েছে স্থায়ী ঠিকানা। সরকারের এমন অন্যন্য উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পেরে আমরাও গর্বিত।