নগরীর ৩৭টি ভবনকে পাঁচবছর পূর্বে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলো সিটি করপোরেশন। পরবর্তী সময়ে ওইসব ভবন ভেঙে ফেলতে চিঠিও দেওয়া হয়। কিন্তু চিহ্নিতকরণ ও চিঠি দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে এ কার্যক্রম। ভবন ভাঙার কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবনে কয়েকশ’ মানুষ বসবাস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন। কতিপয় ভবন মালিকদের খামখেয়ালি আর তিন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার কারণে চিহ্নিত করা ভবনগুলোর বিষয়ে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি নগর ভবন কর্তৃপক্ষ। বিপরীতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোতে পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন অনেকে। শনাক্ত হওয়া ভবনগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। এ ঝুঁকিপূর্ণর তালিকায় রয়েছে সরকারি দপ্তরের বেশ কয়েকটি ভবনও।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে বসবাস করা বাসিন্দারা জানিয়েছেন, অন্য কোথাও ঘর ভাড়া করে থাকার সামর্থ্য তাদের না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও তারা সেখানে থাকছেন। বরিশাল সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল বাশার জানিয়েছেন, পাঁচ বছর আগেই ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। ওইসব ভবন মালিকদের একাধিকবার নোটিশও দেওয়া হয়েছে। আমরা তাদের আহবান জানিয়েছি, যেন তারা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো অপসারণ করে নেন। তিনি আরও বলেন, নোটিশ দেওয়ার পরেও পাঁচ বছরে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা কোনো ভবন অপসারণ করা হয়নি।
এসব ভবন নিয়ে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত সর্ম্পকে জানতে সিটি করপোরেশনের স্থপতি হাসিবুর রহমান টিপুর সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভবন মালিকদের নোটিশ দেওয়া হলেও তারা এসব ভবন অপসারণের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে অনাগ্রহী। অনেকে নোটিশ পেয়ে উল্টো মামলা করেছেন। তবে আমরা সদর রোডের অতিঝুঁকিপূর্ণ শাকুর ম্যানশনটি ভাঙার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি। সিটি করপোরেশনের তালিকা অনুযায়ী ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো হচ্ছে-কাউনিয়ায় জানুকিসিংহ রোড সংলগ্ন মতি লস্করের ভবন, পূর্ব বগুড়া রোডের কাজী অফিসের পেছনের রবীন্দ্রনাথ সেনের ভবন, আগরপুর রোডের মহিলা কলেজের দক্ষিণ পাশে মনু মিয়া গংদের দেব ভবন, ফজলুল হক এভিনিউর আবদুর রউফ হায়দারের হোটেল বাহাদুর, সার্কুলার রোডের সৈয়দ মনছুর আহমেদের ভবন, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সড়কের ফাতেমা খাতুনের শাকুর ম্যানশন, ঈশ্বরবসু রোডের সৈয়দ মঞ্জিল, হাসপাতাল রোডের অমৃত লাল দে কলেজর দক্ষিণ পাশে মান্নান মৃধার ভবন, কালুশাহ সড়কের জালাল আহমেদের ভবন, মেজর এমএ জলিল সড়কে সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের ছাত্রাবাস, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের ভেতরের জ্ঞান বিজ্ঞান ভবন, মেডিকেল কলেজ রোডের ফরিদ উদ্দিনের ভবন ক্ষণিকা, সরকারি বিএম কলেজের সুরেন্দ্র ভবন ছাত্রাবাস, বগুড়া রোডের সালাম চেয়ারম্যানের পুরাতন ভবন, একই রোডের পশ্চিম পাশে হাজী ইসরাইলের ভবন, নগরীর ৯ নম্বর ওয়ার্ডের অবস্থিত গণপূর্ত বিভাগ এবং পুলিশ সুপারের তদারকিতে থাকা মালখানা ও গারদখানা, কলেজ রোডের ফরিদ উদ্দিন ভবন, উপজেলা পরিষদের পুরাতন ভবন, সদর রোডের সৈয়দ গোলাম মাহাবুবের সৈয়দ ভবন, কাউনিয়া প্রধান সড়কের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বেনী লাল গুহ ভবন, রূপাতলীর নলছিটি প্লাজা, কাটপট্টি রোডের রফিকুল ইসলামের মিল্লাত ফার্মেসি, একই রোডের নাছির উদ্দিনের চন্দ্রীকা ব্রাদার্স, স্বপনের আহম্মেদ ক্লথ স্টোর্স, কাঠপট্টির আবদুর রহমান তুহিনের ভবন, একই রোডের সৈয়দ জামাল হোসেনের সুমন ব্রাদার্স, সৈয়দ কামাল হোসেন রুবেলের ভবন, সৈয়দ চুন্নু মিয়ার ভবন, চিত্ত সাহার ভবন, নরেশ চন্দ্র ঘোষ ও জোগেশ চন্দ্র ঘোষের ভবন, সৈয়দ জামাল হোসেন নোমানের অমৃত ভবন, ফজলুল হক অ্যাভিনিউর গোল্ডেন টাওয়ার ভবন, হাসপাতাল রোডের মনিরুজ্জামানের ভবন এবং বগুড়া রোডের অপসোনিনের সামনে মাহাবুব হোসেনের ভবন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত হওয়া ৩৭টি ভবনের মধ্যে হাতেগোনা ৩/৪টি ভবন ছাড়া বাকিগুলোতে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মানুষের বসবাস রয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ভবনের মালিকরা বলেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাদের ভবনগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে শনাক্ত করেছে নগর কর্তৃপক্ষ।
ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের বিষয়ে সরকারি ব্রজমোহন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. গোলাম কিবরিয়া বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন শনাক্ত হওয়ার পরে অপসারণের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ধাপ পার হতে হয়। এরমধ্যে প্রতœত্তত্ব অধিদপ্তর ও জেলা সমন্বয় কমিটির অনুমোদন দরকার। আমাদের কাজের বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এখন জেলা সমন্বয় কমিটির অনুমোদন পেলেই সংশ্লিষ্ট দপ্তর ভবন অপসারণে কাজ শুরু করবে। সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল বলেন, কলেজের সৈয়দ আলমগীর ছাত্রাবাসটি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে শিক্ষার্থীরা এখন আর বসবাস করেনা। তবে কলেজ ক্যাম্পাসে জ্ঞান-বিজ্ঞান ভবন নামে কোনো ভবন আছে কিনা তা আমার জানা নেই। সিটি করপোরেশন এমন ভবন ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত করলো কীভাবে জানি না।
নগরীর বিশিষ্টজন অধ্যাপক শাহ্ সাজেদা বলেন, নগরীতে শনাক্ত হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো দ্রুত অপসারণ করা না হলে ভবিষ্যতে যেকোনো সময়ে মারাত্মক কোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এসব ভবন একাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে। এজন্য ভবনগুলো নিয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পরেছে।
বরিশালের সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক কাজী ফিরোজ বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নিয়ে দুটি বিষয় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে। প্রথমত পাঁচ বছর আগে যে ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত হয়েছে সেগুলো এখনো ভেঙে পরেছে কিনা? যদি না পরে তাহলে কি সঠিক উপায় অবলম্বন করে ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত করা হয়েছে, নাকি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সেটি মুখ্য বিষয়। দ্বিতীয়ত যাদের ভবন ঝুঁকিপূর্ণ শনাক্ত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কেন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছেনা। কারণ এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের জন্য আরও অনেকের ক্ষতির কারণ হতে পারে। কাজী ফিরোজ আরও বলেন, যিনি ভবন মালিক তিনি বিভিন্ন কারণে ভবন ভাঙতে নাও চাইতে পারে। সুতরাং সিটি করপোরেশনের উচিত জনমত গঠণ করা। এজন্য গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি প্রচার, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া উচিত। নয়তো শুধু শনাক্ত করেই নগর কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে পারে না।