ঝিনাইদহ কালীগঞ্জের জাহাঙ্গীর আলম যখন ৬ষ্ঠ শেনীর ছাত্র হতদরিদ্র পরিবারের বড় সন্তান হওয়ায় প্রায়ই তাকে বাবা ফেরিওয়ালা মিরাজুল হকের সাথে কাজে যেতে হত।
একদিন বাবার সাথে গিয়েছিল এক আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে। সেখানে ওই ফ্যাক্টরির মালিক ছোট্ট ছেলেটিকে দেখে তার ফ্যাক্টরিতে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বাবা তার উত্তরে বলেছিলেন, আমার ছেলে লেখাপড়া শিখবে, এমন কাজ করাবো না। তাকে আমি উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে গ্রাজুয়েট বানাবো।
প্রয়োজনে নিজের রক্ত বিক্রি করেও দেখতে চায় ছেলের গলাতে টাই ঝুলবে। বাবার এমন কথা শুনে ফ্যাক্টরির লোকজন তার সামনেই অট্টহাসি ও তাচ্ছিল্যভরে বাবাকে উপহাস করেছিলাম। সেই দিনের ঘঁটনায় বেশ কষ্ট পেলেও মনে জেদ এসেছিল একদিন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত জাহাঙ্গীরের। তাইতো শত বাধা ও দারিদ্রতার মধ্যেও জাহাঙ্গীরের আদম্য চেষ্টা বিফলে যায়নি। আজ সে দেশের সর্বচ্ছো বিদ্যাপিঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে সদ্য ঘোষিত ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারি প্রাপ্ত। এখানেই শেষ নয়। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরের কলেজ পাড়ার বাসিন্দা ফেরিওয়ালা মিরাজের পরিবারে রয়েছে জাহাঙ্গীরের মত আরেক নক্ষত্র। জাহাঙ্গীরের সহোদর ছোট ভাই আলমগীর মোল্লা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্ব ধর্ম ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ও বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের খেলোয়াড়।
কালীগঞ্জ কলেজ পাড়ার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানায়, তার পিতা মিরাজুল হক পেশায় একজন ফেরিওয়ালা। শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বাসে ও পরিবহনে ফেরি করে বিভিন্ন খাদ্য দ্রব্য ও প্রসাধনি বিক্রি করে বেড়ান। মা জুলেখা বেগম শহরের অগ্রনী ব্যাংকের একজন পরিছন্নতাকর্মী। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে জাহাঙ্গীর বড়। ছোটবেলা থেকেই অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বড় হতে হয়েছে তাকে।
সদ্য ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারি প্রাপ্ত জাহাঙ্গীর জানায়, তার সফলতার পেছনে হতদরিদ্র বাবা মায়ের অবদানই বেশি। বাবা মায়ের সামান্য আয়ে শত অভাব অনটনের মধ্যেও তারা তার লেখাপড়া বন্ধ করেনি। বাবা ফেরি করে আর মা চাকুরীরি পাশাপাশি বাড়িতে হাঁস মুরগী ছাগল পালন করেই বাড়তি রোজগারে তাদের দু’ভায়ের লেখাপড়ার খরচ বহন করেছেন। জাহাঙ্গীরের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, টিনের ছাবড়া ও চাটাইয়ের বেড়া দিয়ে করা দুই রুমের খুপড়ি ঘরেই তাদের বসবাস। প্রতি রুমে ২ টি করে খাট রয়েছে। তার একটি রুমেই থাকত দুই নক্ষত্র জাহাঙ্গীর ও আলমগীর। এ সময় কথা হয় তাদের বাবা ফেরিওয়ালা মিরাজুল হকের সাথে। তিনি জানান, স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে সহ ৬ সদস্য্যর সংসার তার। ১৯৮৮ সাল থেকে তিনি হকারী পেশায় আছেন।
তিনি গাড়িতে গাড়ীতে বাদাম, শোষা, তিলের খাঁজাসহ বিভিন্ন খেলনা সামগ্রীী বিক্রি করেন। তার স্ত্রী কালীগঞ্জ শহরের অগ্রনী ব্যাংকের একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী। স্বামী- স্ত্রীর সামান্য আয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তিনি জানান, অভাবের কারণে তার দুই মেয়েকে মাধ্যমিক পেরনোর আগেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু তার ইচ্ছে ছিল দুই ছেলেকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করবেন। এজন্য তাদের পড়ালেখার খরচ বহনে বিভিন্ন সময়ে এনজিও থেকেও ঋণ নিয়ে দেনাও হতে হয়েছে। তবে, আজ তিনি সার্থক হয়েছেন বলে এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়েন।
মিরাজুল হকের স্ত্রী জুলেখা বেগম জানান, চাকুরির পাশাপাশি তিনি বাড়িতে হাঁস মুরগী ছাগল গরু পালন করতেন। অভাবের সংসারে খেয়ে না খেয়ে তারা অনেক কষ্টে ছেলে দুটির পড়ালেখা চালিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ে অধ্যায়নরত অবস্থায়ই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিল জাহাঙ্গীর। তার দুটি ছেলে মেয়ে। স্ত্রী একজন গৃহনী। তার এই সাফল্যের পেছনে মায়েরই বেশি অবদান জানিয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, কালীগঞ্জ সরকারী মাহাতাব উদ্ধিন কলেজ থেকে এইচ এস সি পাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ২০১৮- ১৯ শিক্ষা বর্ষে মাষ্টাস শেষ করে করোনার কারণে বাড়িতে চলে আসেন। এরপর কালীগঞ্জ বড় সিমলা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দেন। এরিমধ্যে সে বিসিএসে অংশ নিয়ে ৪১তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারি প্রাপ্ত হয়।
জাহাঙ্গীর জানায়, তার ফেরিওয়ালা পিতা একজন বঙ্গবন্ধু প্রেমিক মানুষ। পিতার নিজের প্রচেষ্টায় এম ইউ কলেজের সন্মুখে গড়ে তুলেছেন বঙ্গবন্ধু স্মৃতি পাঠাগার। তার পিতার আরো এক স্বপ্ন পাঠাগারটি একদিন আলোর মুখ দেখবে। পিতা আমার স্বপ্ন পুরন করেছে। তাই আমিও আমার চাকুরির অর্থ দিয়ে একদিন পিতার স্বপ্ন পূরন করব।
এক ফেরিওয়ালার পরিবারে দুই নক্ষত্র, এ যেন ভাঙ্গা ঘরে চাঁদের আলো। এমনটাই মন্তব্য করে কালীগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আশরাফুল আলম আশরাফ বলেন, চেষ্টা মানুষকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। ফেরিওয়ালা মিরাজুল তার জ¦লন্ত প্রমান।