রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে এক অর্থ বছরেই প্রায় চার কোটি টাকার অনিয়মের তথ্য পেয়েছে নীরিক্ষা দপ্তর। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে সামাজিক নিরাপত্তা অধিদপ্তরের অডিটে এ আপত্তি তোলা হয়েছে। আপত্তিতে বলা হয়েছে, রাজশাহী সেফ হোমের প্রাচীর নির্মাণ না করেই ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। এছাড়াও ক্যান্সার, কিডনি ও জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা ব্যয়ের ১১ লাখ টাকা অনুদান আত্মসাৎসহ ভুয়া বিল ভাউচারে এবং কোটেশনের নামে একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে ১৪টি প্যাকেজের ১০টি কাজ দেওয়ার মতো অনিয়ম পেয়েছে। আর ওই অডিট রিপোর্টটিও ধামা-চাপা দিতে নীরিক্ষাকারী দলকে মোটা অংকের উৎকোচ দেওয়া হয়েছিল। ফলে অনিয়মের আরও বেশকিছু অংশ বাদ দিয়ে একেবারে গোপনযোগ্য নয়, এমন বিষয়ে শুধুমাত্র আপত্তি দেওয়া হয়েছে বলেও রাজশাহী জেলা সমাজ সেবা দপ্তরেরই একটি বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, সমাজ সেবা কার্যালয় থেকে আনিসা বেওয়া ও আনিছুরা বেগম নামে রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া এলাকার এই দুই নারীকে ৫০ হাজার করে ১ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আদৌ এ দু’জনের কেউই টাকা পাননি। তাঁরা পরস্পর আপন দুই বোন উল্লেখ থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁরা সম্পর্কের কেউ নন। এমনকি তারা বোয়ালিয়া এলাকারও বাসিন্দাও নন। আনিসা বেওয়ার বাড়ি মতিহার থানার মেহেরচন্ডী। আর আনিছুরার বাড়ি কাটাখালী থানার বুধপাড়া এলাকায়। অসুস্থ এই দুই নারীর চিকিৎসার জন্য বরাদ্দকৃত ১ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
এ ঘটনায় আনিসা বেওয়ার বোন আফরোজা বেগম বলেন, চিকিৎসা সহায়তার জন্য রাজশাহী সমাজসেবা কার্যালয়ে তারা আবেদন করেছিলেন। আবেদনের প্রেক্ষিতে টাকা দেয়ারও কথা ছিল। কিন্তু পরে আর সেই টাকা পাননি।
এছাড়াও রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের তেলীপুকুর গ্রামের স্ট্রোকে প্যারালাইজড হওয়া রোগী আবদুল জলিল থান্দারকে ৫০ হাজার দেওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। পরে অধিদপ্তরের রেজিষ্টারে থাকা সুবিধাভোগীর মোবাইল নম্বরে যোগাযোগ করা হলে দেখা যায় নম্বরটি ওই ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আলমগীর সরকারের। তখন বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, এটি তারই (ইউপি চেয়ারম্যান) মোবাইল নম্বর। আর তার জানা মতে জলিল থান্দার সহায়তার কোন টাকা পাননি।
এদিকে, রাজশাহী সমাজসেবা দপ্তর থেকে যাদের নামে টাকা দেওয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে এমন ১২ জন রোগী ও তাদের স্বজনদের মোবাইল নম্বর যাচাইকালে এমন জালিয়াতির তথ্য ধরা পড়ে। এভাবে ক্যান্সার, কিডনি ও জটিলরোগে আক্রান্তদের চিকিৎসা সহায়তা দেওয়ার কথা বলে ১ বছরেই ১১ লাখ টাকা নয়-ছয় করা হয়েছে। আর রাজশাহী সমাজসেবা কার্যালয় দপ্তরের উপণ্ডপরিচালক হাসিনা মমতাজের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এসব অনিয়ম করা হয়েছে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
অডিট প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের আওতায় বিভিন্ন পণ্য কেনার জন্য কোটেশন বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান যোগ্যতার সমর্থনে প্রমাণপত্র ছাড়াই দরপত্র কোটেশন জমা দেয়। পণ্য সরবরাহের পর তাদের বিলও পরিশোধ করা হয়েছে। এভাবে কোটেশন করে ১২ লাখ ৪০ হাজার টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। যার মধ্যে অধিকাংশই ভুয়া বিল-ভাউচারে খরচ করা হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী কোটেশনও দেখানো হয়নি।
রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নেও ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের যোগসাজশে সরকারী অর্থ নয়ছয় হয়েছে বলেও অডিট প্রতিবেদনে ধরা পড়েছে। অডিট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- উন্মুক্ত দর পদ্ধতি অনুসরণ না করে একই ব্যক্তিকে খ-খ-ভাবে বিভক্ত করে কোটেশনের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হয়েছে। আর এভাবে ৬৪ লাখ ৬৭ হাজার ১৩৭ টাকার খরচ দেখানো হয়েছে। এই টাকা পবা উপজেলার বায়া সরকারী শিশু পরিবার (বালক) এর সেমিপাকা ডায়নিং রুম, রান্নাঘর স্টোর রুম নির্মাণকাজ, সীমানা প্রাচীরের নিচে ইটের গাঁথুনি ও প্লাস্টার, ছোটমনি নিবাসের প্রধান গেট নির্মাণ, বায়া সেফ হোম ডরমেটরি ভবনের অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক মেরামতকাজ এবং পিএইচটি সেন্টারের সীমানা নির্মাণকাজের জন্য বরাদ্দ ছিল। কিন্তু এই কাজের জন্য একসাথে উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান না করে ছোট ছোট ১৪টি প্যাকেজে দেখানো হয়েছে। এরমধ্যে ১০টি প্যাকেজেরই কাজ করেছে মেসার্স রেহেনা এন্টারপ্রাইজ। এছাড়াও মেসার্স সোনালী এন্টারপ্রাইজ দুটি ও মেসার্স মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজ এবং মেসার্স আল মদিনা একটি করে প্যাকেজের কাজ করেছে। এক্ষেত্রেও পিপিআর-২০০৮ লঙ্ঘন করা হয়েছে। এমনকি সেফ হোমের প্রাচীর নির্মাণ না করেই ৫ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর অন্য কাজগুলো যত্রতত্র করে অধিকাংশ টাকা লোপাট করা হয়েছে।
অডিট প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে অধীনস্ত অফিসসমূহে ২০২১-২২অর্থবছরে বার্ষিক ক্রয় পরিকল্পনা ছাড়াই পৌনে তিন কোটি টাকার মালামাল কেনা হয়েছে। এক্ষেত্রেও পিপিআর-২০০৮এর বিধি-১৬(৬) মানা হয়নি। এ ছাড়া প্রাপ্যতার চেয়েও অতিরিক্ত গাড়ির গ্যারেজের ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে রাজশাহী বিভাগীয় ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ে।
অডিট প্রতিবেদনে দেখা যায়, ভাড়ার চুক্তি অনুযায়ী দুটি কার্যালয়ের জন্য ১ লাখ ২৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা করার কথা থাকলেও ৩ লাখ ৬০ হাজার ৪২১ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। সরকারী অর্থ খরচে অনিয়ম করায় দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণেরও সুপারিশ করা হয়েছে ওই অডিট প্রতিবেদনে।
এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের উপণ্ডপরিচালক হাসিনা মমতাজ বলেন, তিনজন রোগীর মোবাইল নাম্বার একটাই কী করে হলো, তা আমার জানা নেই। আর কোনো কাজেরই অনিয়ম হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম মেনেই কাজ কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। আর তারা অভিজ্ঞ এবং দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে আসছে।