ভর্তি পরীক্ষায় প্রক্সি ও চাঁদা দাবির ঘটনায় প্রক্সি জালিয়াতির মুল হোতা ও ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশকারী মহিবুল মোমিন সনেটের গভীর ষড়যন্ত্রের কারণেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুশফিক তাহমিদ তন্ময় ‘বলির পাঠা’ হয়েছেন বলে ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে গুঞ্জন। ‘প্রক্সি’ জালিয়াতির মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া এক শিক্ষার্থীর বাবাকে নিজের নম্বর থেকে তন্ময় পরিচয়ে ফোন করে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করেন সনেট। এতেই ঘটে যায় বিপত্তি। বিষয়টির খোঁজ-খবর কিংবা তদন্ত না করেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও প্রক্সিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর মা ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়কে প্রধান আসামি করে থানায় মামলা করেছেন বলেও চলছে সমালোচনা। আর ছাত্রলীগে ‘অনুপ্রবেশকারী’ সনেটর এমন সাজানো নাটক ধরতে না পেরে তড়িঘরি করে ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়সহ চারজনকে (এর মধ্যে মুল হোতাও রয়েছে) স্থায়ী বহিস্কারও করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।
অনুসন্ধানে উঠে গেছে, জামায়াত-শিবির পরিবারের সন্তান মহিবুল মোমিন সনেট। বাড়ি পিরোজপুরে। সনেটসহ তার পুরো পরিবার জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আর রাবিতে ভর্তির পর সনেট প্রক্সি জালিয়াতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। এরপর নির্বিঘেœ প্রক্সি জালিয়াতি কর্মকা- চালানোর সেল্টার নিতেই ছাত্রলীগে অনুপ্রবেশ করে সনেট।
অনুসন্ধানে আরো উঠেছে, ক্যাম্পাসে প্রক্সি জালিয়াতির মূল হোতা সনেটের ভর্তি জালিয়াতির মাধ্যমে রাবির বিভিন্ন বিভাগে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে পড়ালেখা করছে। গত বছরের ১১ নভেম্বর একটি শীর্ষ জাতীয় দৈনিকসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনও প্রকাশ হয়। কিন্তু তারপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ভর্তি জালিয়াতির মূল হোতা সনেট ও জালিয়াতি করে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আইনগত কিংবা অ্যাকাডেমিক কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেন নি। এছাড়াও চলতি বছরের মার্চ মাসে প্রক্সি জালিয়াতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে সনেটের বিরুদ্ধে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া মডেল থানায় একটি মামলাও হয়েছিল। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার (১৭ আগস্ট) সনেটের মাধ্যমে প্রক্সি জালিয়াতি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স অ্যান্ড হিউম্যান রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট বিভাগে ভর্তি হতে মায়ের সঙ্গে ক্যাম্পাসে আসে আহসান হাবীব নামের এক ভর্তিচ্ছু। ওই দিন দুপুর পৌনে ৩টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার জগদিশচন্দ্র বসু অ্যাকাডেমিক ভবনে ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ভবনের বাইরে বের হলে প্রক্সিকা-ের সঙ্গে জড়িত ৩-৪ জন আহসান হাবীবকে অপহরণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা আবাসিক হলের তৃতীয় তলার একটি কক্ষে নিয়ে গিয়ে আটকে রাখে। এরপর অপহরণকারীর একজন মুঠোফোনে তার বাবার কাছে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে।
পরে প্রক্সি জালিয়াতি করে ক্যাম্পাসে ভর্তি হতে আসা আহসান হাবীবের খোঁজ না পেয়ে ওইদিন বিকালেই বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে জানান মা রেহেনা বেগম। খোঁজ-খবর নিয়ে পরে প্রক্টরিয়াল বডির সহায়তায় আহসান হাবীবকে ওই হলের তৃতীয় তলার একটি কক্ষ থেকে উদ্ধার করে প্রক্টর দপ্তরে নিয়ে আসা হয়। তখন জিজ্ঞাসাবাদে আহসান হাবীব স্বীকার করেন, প্রক্সির মাধ্যমে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট বিভাগের শিক্ষার্থী শাকোয়ান সিদ্দিক প্রাঙ্গনের সঙ্গে হাবীবের ৪ লাখ ৮০ হাজার টাকা চুক্তি হয়। ভর্তি হওয়ার আগে প্রাঙ্গনের মাধ্যমে আহসান হাবীবের থেকে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা নেন প্রক্সিকা-ের মুল হোতা সনেট। বাকি ৬০ হাজার টাকার জন্য প্রক্সি জালিয়াতির এই চক্রটি আহসান হাবীবকে অপহরণের পর মুশফিক তাহমিদ তন্ময়ের পরিচয়ে আহসানের বাবার মুঠোফোনে কল করে ৩ লাখ টাকা মুক্তিপন দাবি করে। অথচ যে মুঠোফোন নম্বর (০১৯৮২৭৩৭৯৩৫) থেকে ভর্তিচ্ছুর বাবাকে কল করে মুক্তিপন দাবি করা হয়েছে সেটি প্রক্সি জালিয়াতির মুল হোতা মহিবুল মোমিন ওরফে সনেটের ব্যবহৃত নম্বর। মূলত ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়কে ফাঁসাতেই সনেট ভয়াবহ এই নাটক সাজিয়েছিলেন।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শের-ই-বাংলা আবাসিক হলের প্রধান ফটকের সামনে থাকা সিসিটিভি ফুটেজ পর্যবেক্ষণেও ওই শিক্ষার্থীকে হলে নিয়ে যাওয়ার সময় থেকে শুরু করে সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রলীগ নেতা তন্ময় ওই হলে প্রবেশ করেনি। এমনকি ওইদিন ছাত্রলীগের এই নেতাকে ক্যাম্পাসেও দেখা যায়নি।
এ ঘটনায় মুশফিক তাহমিদ তন্ময় বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ কোনো ধরনের তদন্ত না করেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাকে এক নম্বর আসামি করে তাৎক্ষণিক মামলা করেছে। কোনো উপায় না পেয়ে আমি ওইদিন সন্ধ্যায় ক্যাম্পাসে সংবাদ সম্মেলন ডেকে বলেছিলাম যে, প্রক্সি জালিয়াতির এই ঘটনার সঙ্গে আমার নূন্যতম সংশ্লিষ্টতা কেউ প্রমাণ করতে পারলে প্রশাসন ভবনের সামনে আমি নিজের ফাঁসি নিজে কার্যকর করবো। তন্ময়ের দাবি, রাজনৈতিকভাবে ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছি। আবার আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা প্রমাণ হওয়ার আগেই আমাকে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এত দ্রুত এই বহিষ্কারাদেশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ প্রভাব ছাড়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাবি ছাত্রলীগের এক সহ-সভাপতি বলেন, তন্ময়ের সামনে রাজনৈতিক সম্ভাবনাকে নষ্ট করতে প্রক্সি জালিয়াতির মূল হোতা সনেটকে দিয়ে তন্ময়কে ‘বলির পাঠা’ বানানো হয়েছে। শুনেছি, এই সনেটের প্রক্সি জালিয়াতির জ¦ালের মাধ্যমে রাবিতে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। এনিয়ে ওই সময় ভর্তি পরীক্ষায় সনেট কীভাবে জালিয়াতি করে বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়েছিল তার একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রথম সারির একটি জাতীয় দৈনিকসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। তখন ব্যবস্থা নিলে এই সনেট বিশ্ববিদ্যালয়ে জালিয়াতি করে একজনকে ভর্তি করিয়ে তাকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক একটি হলে আটকে রেখে মুক্তিপণ চাওয়ার সাহস পেতো না। তাই নিরোপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দোষীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হলে ভবিষ্যতে এ ধরণের অপরাধ আর কেউ করতে সাহস দেখাবেনা বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এদিকে বহিস্কারের বিষয়ে জানতে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ সভাপতি মো. সাদ্দাম হোসেনকে মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সংযোগ স্থাপন সম্ভভ হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে শের-ই-বাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আমি প্রক্টরিয়াল তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারি হলের মধ্যে একজন ভর্তিচ্ছুকে আটকে রাখা হয়েছে। পরে তাদের হল থেকে উদ্ধার করে প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. আসাবুল হক বলেন, ‘আমরা মূলত ভর্তিচ্ছু ও তার বাবার বক্তব্য শুনে মামলা করেছি। এখন পুলিশ সব খতিয়ে দেখবে। তারপর তারা প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবদুস সালাম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টটরিয়াল তথ্যের ভিত্তিতে আমরা মামলা করেছি। পরবর্তীতে আইন তার নিজ গতিতে চলবে।’