দাসত্ব বলতে বোঝায় কোন মানুষকে জোর করে শ্রম দিতে বাধ্য করা এবং এ ক্ষেত্রে কোন মানুষকে অন্য মানুষের অস্থাবর সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা। আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্য স্মরণ এবং রদ দিসব আজ। ইউনেস্কোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ সাল থেকে প্রতি বছর ২৩ আগস্টকে আন্তর্জাতিক দাস বাণিজ্য স্মরণ এবং রদ দিসব হিসেবে উদযাপন করা হয়। ১৭৯১ সালের ২২ ও ২৩ আগস্ট রাতে হাইতি এবং ডমিনিকান প্রজাতন্ত্রে এক বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল সেটিই দাস প্রথা বিলুপ্তির পথে মানব সভ্যতাকে অনেকদূর এগিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে আইন করে দাসপ্রথা নিষিদ্ধ করা হয়। এই দিবস পালনের মুল উদ্দেশ্য হলো মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও দাসদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা। মানব ইতিহাসে অনেকগুলো নিন্দাজনক অধ্যায় রয়েছে যার ভিতর এই দাসপ্রথা অন্যতম। সভ্যতার সৃষ্টির পরপরই সামাজিক ব্যাধির মতো চালু হয় ক্রীতদাস প্রথা। এরপর সময় যতো গড়িয়েছে, বেড়েছে এই দাসদের প্রতি অমানবিক নির্যাতনের পরিমাণ। ক্রীতদাস প্রথার ইতিহাস অতি প্রাচীন। যতদূর জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ থেকে ৩০০০ সালে মেসোপটেমিয়ায় প্রথম ক্রীতদাস প্রথার চালু। তারও হাজার খানেক বছর পর থেকে এই প্রথা ছড়িয়ে পড়ে মিশর আর ভারতে। তারও অনেক অনেক পরে চীনে জাঁকিয়ে বসে অমানবিক এই প্রথা। ৮০০ থেকে ৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গ্রিস এবং ২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রোমে শুরু হয় ক্রীতদাস প্রথার বিস্তার। এভাবে প্রায় বিশ্বজুড়েই একসময় ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়াবহ প্রথাটি। পণ্যসামগ্রীর কেনাবেচার মতো দাস-দাসী কেনাবেচা হতো, বসত দাসের হাট। ছিল না তাদের কায়িক শ্রমে উপার্জনের কোনো অধিকার, মানুষ হিসেবে তাদের কোনো মানবিক অধিকার ছিল না। এই দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ ব্যক্তিদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই স্থান বা মালিকানা পরিবর্তন করা হতো। অতীতে কোন কোন সমাজে নিজের দাসকে হত্যা করাও আইনসংগত ছিলো। বাংলার বাজারে ১৮৩০ সাল পর্যন্তও হাবশী ও কাফ্রি নামে পরিচিত আফ্রিকান ক্রীতদাস-দাসী আমদানি করা হতো। বাংলায় সাধারণত ধনী সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিগণ, এবং মুসলিম ও ইউরোপীয় বণিকগণ কঠোর পরিশ্রমী ও কর্তব্যনিষ্ঠ বলে খ্যাত হাবশীদেরকে দাস হিসেবে রাখত। ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা তাদের পণ্য পরিবহন ও কারখানা প্রহরার জন্য নিয়মিত শ্রমিকের বিকল্প হিসেবে ক্রীতদাসদের নিয়োগ করত। ইউরোপে মানবতাবাদী আন্দোলনের প্রভাবে, উনিশ শতকের গোড়া থেকে, এবং গুরুতর ভাবে ১৮২০ সাল হতে, ব্রিটেনে ক্ষমতাসীন সরকার দাসপ্রথা নিরুৎসাহিত করে। ১৮৩৩ সালের চার্টার অ্যাক্ট দ্বারা যথাসম্ভব দ্রুত সব ধরনের দাস প্রথা অবলুপ্ত করার সুস্পষ্ট পদক্ষেপ নিতে কলকাতার সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হয় এবং ১৮৪৩ সালে অ্যাক্ট ফাইভ আইন দ্বারা দাসদাসী আমদানি ও রপ্তানি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৮৬১ সালে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ক্ষমতা গ্রহণের কিছুদিন পরই আমেরিকায় শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। এ সময় তিনি ১০ হাজারের মতো দাসকে মুক্ত করেছিলেন। তাই আমেরিকায় দাসপ্রথা বিলুপ্তিতে তাকে অন্যতম কর্ণধার মনে করা হয়। এই অমানবিক প্রথার অবসানকে চিহ্নিত করতে এবং প্রথাটির বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রামের নায়কদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে, জাতিসংঘের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৪৮ থেকে প্রতিবছর ২৩ আগস্ট পালিত হয় আন্তর্জাতিক দাসপ্রথা বিলোপ দিবস।