বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার। ফলে দেখা যাচ্ছে তরুণদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয়ের বিস্তার। দিন দিন এটা মহামারীর মতো বেড়েই চলেছে। বর্তমানে অসামাজিক কার্যকলাপ ও সামাজিক শিথিলতা বাড়ছে। ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ বিজ্ঞানের অভাবনীয় অগ্রগতি হয়েছে। সেই অগ্রগতি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারে। তবে প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা অনেক অগ্রসর হয়েছি এবং ইন্টারনেটের আওতায় এদেশের সিংহভাগ জনগোষ্ঠী চলে এসেছে। ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ শিক্ষিত ব্যক্তি সক্রিয়। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যোগাযোগ বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকাকে অস্বীকার করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। তবে এ যোগাযোগে কোনো বন্ধন তৈরি হচ্ছে না। বরং পারিবারিক, আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বের সম্পর্কে যে বন্ধন রয়েছে সেই বন্ধনেও শৈথিল্য দেখা দিয়েছে। প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে, মানুষে মানুষে সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে। একঘরে থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন, এক আড্ডায় থেকেও সবাই সবার কাছ থেকে দূরে। ইমেইল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছে প্রতিটি প্রাণ। প্রকৃত গণমাধ্যমও ম্লান হয়ে যাচ্ছে অনলাইন সাংবাদিকতার দৌরাত্ম্য। নূন্যতম যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ছাড়াই কোনো কোনো ব্যক্তি অনলাইন সাংবাদিকতার প্লাটফর্ম খুলে বসেছেন। ভিত্তিহীন সংবাদ, গুজব এবং অপপ্রচারই এদের মূলধন। তাদের পরিবেশিত সংবাদে চটকদার উপাদানের প্রাধান্য থাকায় বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে। সংক্রামক ব্যাধির মতোই অপসাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালজুড়ে।
সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার এ স্বার্থপরতাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক চর্চা যে হচ্ছে না এমন নয়। কিন্তু নেতিবাচক ভূমিকার কাছে সেটি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। এর প্রতি আসক্তি-মাদকাসক্তির চেয়ে কম বিপজ্জনক নয়। তরুণ প্রজন্মের জন্য এ পরিস্থিতি আসলেই অশনি সংকেত। মাদক, যৌন হয়রানি, নারী নির্যাতন, জঙ্গিবাদের মতো অপরাধে তরুণরা কেন ঝুঁকে পড়ছে এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করেছেন। একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিচ্ছিন্নতা এবং আত্মকেন্দ্রিকতা তরুণদের বিপথগামী হওয়ার অন্যতম কারণ। অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসামাজিকতা অপরাধপ্রবণতার জন্ম দিচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা সহজেই নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ তৈরি করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে শারীরিক সম্পর্কও তৈরি হচ্ছে। একসময় মোহভঙ্গ হলে সম্পর্কের অবসান ঘটছে। কখনো কখনো বিক্ষুব্ধ পক্ষ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য নিজেদের অথবা প্রেমিক বা প্রেমিকার অন্তরঙ্গ ছবি ভাইরাল করে দিচ্ছে, যা একটি নতুন অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। কিছুদিন পর অবলীলায় তারা নতুন কাউকে বেছে নিয়ে সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এরপর আবারও সেই পুরনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি। আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা, অভিমানের মতো মানবীয় অনুভূতি গুরুত্ব হারাচ্ছে। এমনকি অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকাও ডিজিটাল ডিভাইসে শব্দার্থ দেখে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন। এটি শিশুদের সঙ্গে প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। এভাবে একটি অর্ধশিক্ষিত প্রজন্ম তৈরি হচ্ছে।
সামাজিক মাধ্যম অজস্র কবি, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, নির্মাতার জন্ম দিচ্ছে, অগণিত ‘ভিউ’ ও ‘শেয়ার’ হচ্ছে। তাদের মধ্যে কত শতাংশ আসলেই প্রতিভাবান সেটি কি আমরা ভেবে দেখেছি? অযোগ্যদের প্রাদুর্ভাবে প্রকৃত প্রতিভা যে আড়ালে চলে যাচ্ছে সেটি কম দুশ্চিন্তার বিষয় নয়। সামাজিক মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে গিয়ে প্রতি বছর কত বইয়ের পাঠক, গানের শ্রোতাও মাঠের খেলোয়াড় এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তা গবেষণার দাবি রাখে। অথচ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হতে পারত সামাজিকীকরণের শক্তিশালী হাতিয়ার। তবে সেটি হয়নি। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে ‘মানুষ অসামাজিক জীব’- এ নতুন পরিচিতি পেতে মানুষের দেরি হবে না। তাই বর্তমান প্রজন্মকে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামাজিকতা থেকে রক্ষা করার জন্য অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। প্রতিটি শিশুই অনুকরণ প্রিয় হয়ে থাকে। তারা বড়দের যা করতে দেখে তাই নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করে ফেলে। শিশুদের সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড়দেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েই যাচ্ছে। একটি শিশুর সামনে কেউ যদি প্রতিনিয়ত বই পড়ে, বাগান করে, গান করে, ছবি আঁকে বা নানা রকম প্রোডাক্টিভ কাজে নিজেদের জড়িয়ে রাখে শিশুরা তখন সেগুলোই অনুকরণ করে। ফলে পরিবারের সদস্যদের উচিত অবসর সময়ে সকলে মিলে আড্ডা দেয়া। এ ছাড়া নানারকম সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানারকম অপব্যবহার ও সময়ের অপচয় সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষের সচেতন করার জন্য নানা রকম সেমিনার ও প্রচার-প্রচারণা করা। সর্বোপরি আশা রাখাই যায়, সব নেতিবাচকতার মধ্যেও ইতিবাচক দিকগুলো গ্রহণ করে একটি সুন্দর প্রজন্ম তৈরি হবে।