বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের আবাসিক ছাত্রী হোস্টেলে র্যাগিংয়ের ঘটনা তদন্তে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠণ করা হয়েছে। র্যাগিংয়ের ঘটনা আড়াল করতে সাংবাদিকদের পেটানো শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সাহাকে তদন্ত কমিটিতে রেখেই কমিটি গঠণ করেছে কলেজ প্রশাসন। এতে করে সঠিক তদন্ত নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে র্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রী ও তার পরিবার।
সোমবার দুপুরে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ নাজিমুল হক জানিয়েছেন, অভিযোগ তদন্তে চার সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠণ করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে কলেজের অধ্যাপক উত্তম কুমার সাহাকে প্রধান করা হয়েছে। বাকি তিন সদস্য হলেন-সহযোগী অধ্যাপক প্রবীর কুমার সাহা, প্রভাষক অনিকা বিশ্বাস ও জহিরুল ইসলাম।
এর আগে কলেজ অধ্যক্ষ ডা. ফয়জুল বাশার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, র্যাগিংয়ের শিকারের অভিযোগ তোলা ছাত্রী মানসিকভাবে সুস্থ নন। তার চিকিৎসার জন্য পরিবার থেকে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তবে এসব কথা বলার পর আর সাংবাদিকদের সামনে আসছেন না ফয়জুল বাশার। তার সাথে একাধিক সাংবাদিকরা যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
কলেজের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, র্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রীর অভিযোগের পক্ষে বক্তব্য রেকর্ডের জন্য শনিবার ও রোববার দুইদিনই প্রশাসনিক ভবনে এনে বসিয়ে রাখা হয়। একইসাথে অভিযোগ তুলে নেওয়ার জন্য চাঁপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। ছাত্রলীগ নেত্রীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা অভিযোগ তুলে না নিলে একাডেমিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে লেখাপড়া শেষ করতে চায় নাকি বিচার চায় এর যেকোনো একটি বেঁছে নেওয়ার জন্য র্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রীকে বলা হয়েছে।
কলেজ প্রশাসনের এমন চাঁপে বিপাকে পরেছেন র্যাগিংয়ের শিকার ছাত্রী ও তার অভিভাবকরা। ওই ছাত্রীর মা জানিয়েছেন, আমার মেয়ে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে বিচার চাইতে এসে এখন প্রতিকূল পরিবেশ অতিক্রম করতে হচ্ছে। নির্যাতনের শিকার হলো আমার মেয়ে আবার কলেজের শিক্ষকরা আমার মেয়েকে বলছে এসব নাটক সাজিয়েছি আমরা। আমার মেয়ে অভিনয় করছে। মূলত কলেজ প্রশাসন নির্যাতনকারীদের বাঁচাতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করছে বলেও তিনি (ছাত্রীর মা) অভিযোগ করেন।
সচেতন নাগরিক কমিটি বরিশালের সভাপতি অধ্যক্ষ গাজী জাহিদ হোসেন বলেন, যেই হোস্টেলে ছাত্রী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, সেই হোস্টেল সুপার কিছুতেই দায় এড়াতে পারেন না। এ ছাড়া তাকেই আমরা দেখেছি ঘটনাটি গণমাধ্যমে যেন না আসে সেজন্য সাংবাদিকদের হেনস্থা করতে। সেই শিক্ষক প্রবীর কুমার সাহাকে তদন্ত কমিটিতে রাখায় সঠিক তদন্ত হবে বলে মনে হচ্ছেনা। এতে করে নির্যাতনের শিকার ছাত্রী সঠিক বিচার পাবেনা। তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে। বরিশালেও তেমন ঘটনা ঘটাটা দুঃখজনক। আমি মনে করি শিক্ষার্থীদের শিক্ষা আবাসনের নিরাপত্তায় এ ঘটনার সঠিক তদন্ত করে কঠোর বিচার করা উচিত।
অপরদিকে ছাত্রীকে র্যাগিং দেওয়া ও মানসিক নির্যাতনসহ সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্তসহ দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট। নগরীর অশ্বিনী কুমার হল চত্বরে সংগঠনের বরিশাল মহানগর শাখার আয়োজনে এ কর্মসূচি পালিত হয়। সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের মহানগর শাখার কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটির আহ্বায়ক বিজন সিকদারের সভাপতিত্বে সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) জেলা শাখার সদস্য সন্তু মিত্র, ছাত্র ফ্রন্টের মহানগর শাখার কাউন্সিল প্রস্তুতি কমিটি সদস্য সচিব সুজন আহমেদ, সদস্য লামিয়া সাইমন, সরকারি বিএম কলেজ শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম, সদস্য মিনহাজুল ইসলাম ফারহান, সরকারি আলেকান্দা কলেজে শাখার সংগঠক ফারহানা আক্তার প্রমুখ।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী হলের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পঞ্চম বর্ষের শিক্ষার্থী ফাহমিদা রওশন প্রভা ও সহ-সম্পাদক নীলিমা হোসেন জুঁই তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে গত ২৩ আগস্ট রাতে দুইদফায় রুমে আটকে রেখে র্যাগিংয়ের নামে মানসিক নির্যাতন চালিয়েছে। একপর্যায়ে ওই শিক্ষার্থী অজ্ঞান হয়ে পরলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ২৬ আগস্ট সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহে গেলে তাদের ওপর কলেজের অধ্যক্ষের উপস্থিতিতেই হামলা চালানো হয়। বক্তারা আরও বলেন, র্যাগিং কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিগত বিষয় হতে পারেনা। প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষা করতে চাইলে সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের অনতিবিলম্বে প্রত্যাহারসহ র্যাগিংয়ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের র্যাগিংমুক্ত গণতান্ত্রিক শিক্ষাঙ্গনের দাবি করেন।
বরিশাল শের-ই বাংলা মেডিকেল কলেজের আবাসিক হলে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে এক ছাত্রীর অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ২৭ আগস্ট হাইকোর্টের নজরে এনেছেন এক আইনজীবী। বিচারপতি জে.বি.এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন আইনজীবী তামজিদ হাসান। তখন বিচারপতিদ্বয় বলেন, পত্রিকা দেখে আমরা কোন বিষয় শুনবো না। প্রয়োজন মনে করলে এ বিষয়ে রিট করতে পারেন। পরে আইনজীবী তামজিদ হাসান বলেন, র্যাগিংয়ের ঘটনা নিয়ে রিট আবেদন দায়ের করবো।
এদিকে র্যাগিংয়ের ঘটনায় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে সাতজন সাংবাদিক হামলার শিকার হওয়ার ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে অনতিবিলম্বে হামলাকারীদের স্ব স্ব পদ থেকে অপসারনের দাবি করেছেন বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরামের (বিএমএসএফ) কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা। হামলার সাথে জড়িত অধ্যক্ষ ও শিক্ষকসহ সকলকে অবিলম্বে আইনের আওতায় এনে শাস্তির মুখোমুখি করারও দাবি করেছেন বিএমএসএফ’র প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আহমেদ আবু জাফর। একই দাবি করেছেন নিউজ এডিটরস্ কাউন্সিল বরিশালের নেতৃবৃন্দরা।
উল্লেখ্য, গত ২৩ আগস্ট রাতে ছাত্রী হলের ৬০৬ নম্বর কক্ষে তৃতীয় বর্ষের এক ছাত্রীকে র্যাগিং করা হয়। এ ঘটনায় গত ২৬ আগস্ট নির্যাতনের শিকার ওই ছাত্রী ও তার মা অধ্যক্ষের কক্ষে বিচার চেয়ে অভিযোগ দিতে যান। এ সময় সাংবাদিকরা তাদের বক্তব্য নিতে গেলে অধ্যক্ষ ডা. ফয়জুল বাশারের নির্দেশে কলেজের প্যাথলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রবীর কুমার সাহা, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক ডা. সৈয়দ বাকী বিল্লাহ সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালায়। ওইদিন রাতেই কলেজের সবগুলো ব্যবস্থাপনা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।