দুইটি আসনে দুইটি পৌর শহরকে ঘিরে গঠিত বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) ও বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনে দীর্ঘদিন থেকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়জয়কার বলে দিচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের সাংগঠনিক ভিত্তি কতোটা মজবুত। তারপরেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটের প্রশ্নে বরাবরেই আওয়ামী লীগ এ আসন দুটি ছেড়ে দিচ্ছে শরিক দলগুলোকে। দলের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়ে তাই বাধ্য হয়েই জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসন দুইটিতে শরিক দলের প্রার্থীদের সাথে থেকে তাদের বিজয় নিশ্চিত করছেন।
কিন্তু নির্বাচনের পর আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কোনধরনের খোঁজখবর কিংবা এলাকার উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারছেন না শরিক দলের নির্বাচিত সংসদরা। আওয়ামী লীগ নেতাদের দাবি, মহাজোটের যে শরিক দলকেই এ আসন দুইটি ছেড়ে দেয়া হয়, তাদের এ আসনে এককভাবে পাঁচ হাজার ভোটও নেই। মূলত মহাজোটের শরীক দলের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের ভোটের কারণেই এ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হচ্ছেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের পর সেই ত্যাগী ও নির্যাতিত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের চরমভাবে অবমূল্যায়নসহ সমাজে নাজেহাল করছেন শরীক দলের নির্বাচিত সাংসদরা। তাই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসন দুইটি আওয়ামী লীগের ঘরে নেয়ার জন্য একক প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেয়ার জন্য দলের সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে নেতাকর্মীরা জোর দাবি করেছেন। নেতাকর্মীরা আরও জানিয়েছেন, দেশব্যাপী উন্নয়নের জোয়ার বয়ে গেলেও দুটি পৌর শহর নিয়ে গঠিত ওই দুইটি আসন বর্তমান সরকারের সবধরনের উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত রয়েছে।
এমন অভিযোগ তুলে এবার ওই আসন দুটি ছাড়তে নারাজ আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দরা। তারা এবার সরাসরি দলীয় প্রার্থীকে নৌকা মার্কায় ভোট দিতে কোমর বেঁধে মাঠে নেমেছেন। অতিসম্প্রতি দলের বিভিন্ন কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের দেওয়া বক্তব্যে তা স্পষ্ট হয়েছে। তবে শরিক দলের নেতৃবৃন্দের দাবি, হাইকমান্ড যে সিদ্ধান্ত দেবেন, তার ওপরই তারা আস্থা রাখবেন।
সবশেষ জাতীয় শোক দিবসের মাসব্যাপী কর্মসূচিতে এ দুটি আসনের বিষয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দরা। তাদের মতে, শরিক দলের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা কোনধরনের উন্নয়ন করেননি। অন্যদিকে সরাসরি ক্ষমতায় না থাকায় দলও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তাই দলের নেতাকর্মীদের চাঙা করার স্বার্থে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী দেওয়া জরুরি হয়ে পরেছে। নতুবা আওয়ামী লীগের দুর্গ হিসেবে পরিচিত এ দুটি আসনেই নৌকার সমর্থক নেতাকর্মীরা পুরোপুরি নিস্ক্রিয় হয়ে যাবে। তাদের আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা।
গত ৩০ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বাবুগঞ্জ উপজেলা চত্বরে অনুষ্ঠিত এক সভায় বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক ও আওয়ামী লীগের উপজেলা কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মোঃ আতিকুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, সারাদেশে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের সুফল ভোগ করলেও বাবুগঞ্জ ও মুলাদীবাসী সবদিক থেকে পিছিয়ে আছে। কারণ একটাই এখানে দলীয় সংসদ সদস্য নেই। তাই দলের নেতাকর্মীদের খোঁজতো দূরের কথা, এলাকার সাধারণ জনগনের মাঝেও বর্তমান সরকারের উন্নয়ন পৌঁছে দেওয়া হয়নি। ওইসভায় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দরা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৩ (বাবুগঞ্জ-মুলাদী) আসন থেকে এবার সরাসরি দলীয় প্রার্থীর নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি করেছেন। সেজন্য ওইসভায় সম্ভ্রাব্য প্রার্থী হিসেবে আতিকুর রহমান আতিকের নামও ঘোষণা করা হয়।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর প্রতিবারই আওয়ামী লীগ বরিশাল-৩ আসনটি শরিক দলগুলোকে ছেড়ে দিয়েছে। আসনটিতে তিনবার নির্বাচিত হয়েছেন বিএনপির প্রার্থী। ২০০৮ সালে মহাজোটের কারণে আসনটি পায় জাতীয় পার্টি (জাপা)। ২০১৪ সালে শরিক দল বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির ঘরে যায়। ২০১৮ সালে ওয়ার্কার্স পার্টি নৌকার টিকিট পেলেও এমপি নির্বাচিত হন জাপার সভাপতিমন্ডলীর সদস্য গোলাম কিবরিয়া টিপু। বাবুগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি কাজী এমদাদুল হক দুলাল বলেন, ১৯৭৩ সাল থেকে এই আসনে আওয়ামী লীগের এমপি নেই। তাই দলীয় নেতাকর্মীরা অনেকটা অভিভাবকশূন্য। তিনি আরও বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এখানকার দলীয় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সবধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়াসহ দলের প্রতিটি কর্মসূচিতে সবধরনের সহযোগিতা করে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকা- প্রচারে জোরালো ভূমিকা পালন করে আসছেন আতিকুর রহমান আতিক। তাই আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দূর্গ হিসেবে পরিচিত বরিশাল-৩ আসনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটাররা আতিকুর রহমান আতিককে নৌকা মার্কার প্রার্থী করার জন্য দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে জোর দাবি করেছেন।
আওয়ামী লীগে যখন নিজ দলীয় প্রার্থীর দাবি, তখন বরিশাল-৩ আসনের বর্তমান এমপি গোলাম কিবরিয়া টিপু বলছেন, তার দল জাপা এবার জোট-মহাজোটে যেখানেই যাক, তিনি ঠিকই প্রার্থী হবেন। এ আসনে আওয়ামী লীগ কোনো দিনই দলীয় প্রার্থী পাবেনা বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলে জয়ের ব্যাপারে শতভাগ আশাবাদী আতিকুর রহমান আতিক বলেন, সরকারের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার কোন বিকল্প নেই। এজন্য সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকান্ডকে সাধারণ ভোটারদের কাছে তুলে ধরতে হবে। তিনি আরও বলেন, ভোটের হিসেবে বরিশাল-৩ আসনটি এককভাবে আওয়ামী লীগের। তাই আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনটি আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দেয়ার জন্য দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সাথে নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছি।
অপরদিকে বরিশাল-৬ (বাকেরগঞ্জ) আসনটি আয়তনে জেলার সবচেয়ে বড় নির্বাচনী এলাকা। মহাজোটের হয়ে মনোনয়ন পেয়ে ২০০৮ সালে এখানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জাপার কো-চেয়ারম্যান রুহুল আমিন হাওলাদার। সবশেষ দুইটি নির্বাচনে এমপি হয়েছেন রুহুল আমিনের স্ত্রী ও জাপার সভাপতিমন্ডলীর সদস্য নাসরিন জাহান রতনা আমিন।
বাকেরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল আলম চুন্নু বলেন, এরশাদ ও আওয়ামী লীগের শাসনামল মিলিয়ে রুহুল আমিন হাওলাদার ৩০ বছর এ আসনের এমপি। উন্নয়ন নিয়ে তার ওপর মানুষের প্রচন্ড ক্ষোভ রয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবারও শরিক দলকে এ আসনে আওয়ামী লীগের সমর্থন দেওয়া হলে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এর প্রতিক্রিয়া দেখাবেন।
উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আমিরুজ্জামান রিপন বলেন, বাকেরগঞ্জ বারবার মহাজোটকে ছেড়ে দেওয়ায় মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। অধিকাংশ ইউনিয়নে এখনো কাঁচা সড়ক। এজন্য ১৫ আগস্ট উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কর্মসূচিতে উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা এবার সরাসরি দলীয় প্রার্থীকে নৌকা মার্কায় ভোট দেওয়ার জোর দাবি জানিয়েছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরিশাল-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের মধ্যে রয়েছেন, দলের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য মেজর জেনারেল (অবঃ) আবদুল হাফিজ মল্লিক, বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার এসএম মঞ্জুরুল হক মঞ্জু, যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান বাদশা, বাকেরগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সামসুল আলম চুন্নু, সাধারণ সম্পাদক ও তিনবারের পৌর মেয়র লোকমান হোসেন ডাকুয়া। দলের নেতাকর্মীদের দাবি, আওয়ামী লীগ থেকে যাকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে এবার তার বিজয় নিশ্চিত করে এ আসনটি প্রধানমন্ত্রীকে উপহার দেওয়া হবে।
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট তালুকদার মোঃ ইউনুস বলেন, বরিশাল-৩ ও বরিশাল-৬ আসনের দলীয় নেতাকর্মীরা যে দাবি করেছেন, এটা তাদের ন্যায্য দাবি। দুইটি আসনই আওয়ামী লীগ অধ্যুষিত দাবি করে তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত দেবেন।