দিঘলিয়ায় কয়েক বছর ধরে কিশোর অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, সিগারেট খাওয়া, এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, এলাকায় নেশা দ্রব্য আমদানি ও বেচা কেনার আধিপত্য, প্রভাব বিস্তারের জেরে হরহামেশা ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, মারধর, দল বেধে হামলা, এমনকি বাড়ির ভেতরে ঢুকে পিতা-মাতার সামনে থেকে তুলে নিতেও দ্বিধা করছে না তারা। গত এক বছরে দিঘলিয়া থানা এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়েছে ব্যাপক। এ সকল কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা বিশ্লেষণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এক সূত্র থেকে জানা যায়, মূলত ছোট অপরাধ থেকে তাদের যাত্রা শুরু। আস্তে আস্তে ইভটিজিং বা বখাটেপনা করলেও পরবর্তীতে খুন, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কেনা-বেচা, ধর্ষণের মতো নৃশংস ঘটনায় জড়িয়ে পড়ছে কিশোররা। এমনকি দল বেঁধে বিরোধী পক্ষের ওপরও হামলা করছে তারা। গত কয়েক বছর ধরে প্রায়ই খবরের শিরোনাম হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’। এমন চক্রের সংখ্যা নেহাত কমও নয়। অভিযোগ রয়েছে, বিশেষ করে সমাজে ‘বড় ভাই’ বা বস পরিচিতি পেতে এসব কিশোর বা উঠতি বয়সী তরুণকে নানা অনৈতিক কাজে ব্যবহার করছে সমাজের এক শ্রেণির ব্যক্তি। কিশোর অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরে কিশোরদের ‘গ্যাং কালচার’ বা সংঘবদ্ধ অপরাধের ভয়ঙ্কর চিত্র সামনে এলেও তা প্রতিরোধে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে কিশোর অপরাধের প্রবণতা কমানো যায়নি, বরং বেড়েছে। সম্প্রতি টিকটক, লাইকির মতো ভিডিও শেয়ারিং অ্যাপ ব্যবহারে ঝুঁকে পড়ছেন কিশোর-তরুণরা। পাশাপাশি মোবাইলে ফ্রি ফায়ার, পাবজি ও টাকা দিয়ে লুডুর নামে জুয়া খেলা। এক্ষেত্রেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন গ্যাং। কিশোর গ্যাংয়ে জড়িতদের অধিকাংশই নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের। তাদের অপতৎপরতা রোধে নেই কারো মাথা ব্যাথা। এরইমধ্যে কিশোর গ্যাংদের অপতৎপরতা প্রতিরোধে পুলিশসহ জনপ্রতিনিধিদের মধ্যেও তৎপরতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রতিরোধে এরইমধ্যে থানা এলাকাতে দাপিয়ে বেড়ানো কিশোর অপরাধীদের তালিকা করা হচ্ছে বলে সুত্রে জানা যায়। তালিকা ধরে খুন, ধর্ষণ, ইভটিজিং, ছিনতাইসহ বড় অপরাধে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। গত ২৫ আগস্ট বেলা ১টার সময় সেনহাটি ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের সেনহাটি মসজিদ পাড়ার রতনের কিশোর পুত্র বাবুকে পুর্ব শত্রুতার জের ধরে পিছন থেকে ধাওয়া দিয়ে ধারালো রাম দা দিয়ে কুপিয়ে মারাত্মক রক্তাক্ত জখম করে। একই দিনে একই এলাকার ৯ নং ওয়ার্ডে সেনহাটি পুলিশ ফাঁড়ির সামনের সুমন, আবুজর, জীবন, ইয়াসিন, নাসিরগং জয় নামে এক কিশোরকে ধারালো ছুরি ও রামদা দিয়ে কুপিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। তারা গরিব ও নিরীহ প্রকৃতির হওয়ায় থানায় মামলা পর্যন্ত করতে সাহস পায় নি। কয়েক মাস আগে সেনহাটি আদর্শ পল্লীতে পূর্ব শত্রুতা ও মাদকের আধিপত্যের লড়াইয়ে মাইনুল ইসলামকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। এ হত্যার সাথে জড়িত বেজি আল আমিন এখনও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছে। জানা যায়, একটি মহল অন্য এলাকা থেকে এসে হীন নিজ স্বার্থ চরিতার্থ করার মানসে এ কিশোর গ্যাংদের আস্ফালনের অভিযোগ এ এলাকার মানুষের মুখে মুখে। স্থানীয়রা জানান, দিঘলিয়া থানার সদর ইউনিয়নের ৩ নং ওয়ার্ডের মহেশ্বরপুর, দিঘলিয়া এমএ মজিদ কলেজ এলাকা, ৫ নং ওয়ার্ডের দেয়াড়া কলোনি বাজার, ব্রহ্মগাতী সরকারি আশ্রায়ণ প্রকল্প এলাকা, গোয়ালপাড়া তেঘাড়ির মোড় এলাকা, সেনহাটি ইউনিয়নের ৮ নং ওয়ার্ডের শিব মন্দিরের আশপাশ ও আদর্শ পল্লী, ৭ নং ওয়ার্ডের কলেজপাড়া, লিচুতলা, মদিনা মসজিদ মোড় এলাকা, ৯ নং ওয়ার্ডের কাটানিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকা, সেনহাটি পুলিশ ফাঁড়ির সামনের সরিষাপাড়া এলাকা, উত্তর চন্দনীমহল ভোগদিয়া এলাকা, বারাকপুর ইউনিয়নের লাখোহাটি ৪ বাড়ির মোড় এলাকা ও চৌধুরী বাড়ির মোড় এলাকা উল্লেখযোগ্য। এ সকল এলাকায় প্রতিদিন বিকেলের পর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত উঠতি বয়সের কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আড্ডা জমায়। থানা পুলিশ মাঝে মাঝে অভিযান করলেও তাদের আড্ডা বন্ধ হয়নি। সেনহাটি কাটানিপাড়ার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জনৈক ব্যক্তি বলেন, সেনহাটি কাটানিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এলাকায় বহিরাগত অপরাধী কিশোররা এসে সাঙ্গ দেয়। কয়েক মাস আগে স্টার ২ নং গেটের রফিকুল ইসলাম নামক জনৈক ঔষুধের দোকানদারের কাছ থেকে টাকা ছিনতাই করে নিয়েছে। এ মুহূর্তে এ এলাকাতে কিশোর গ্যাং ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। এটা এখনই বন্ধ করা দরকার। কিশোর অপরাধীরা এখন শুধু ইভটিজিং কিংবা ছিনতাই করছে না, ধর্ষণ ও মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ছে। তবে কিশোর গ্যাং কালচার বন্ধ করা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ নয়, পরিবার সমাজসহ সব সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকেও এগিয়ে আসতে হবে। বিভিন্ন স্তরের জনপ্রতিনিধিদেরও ভূমিকা ছোট করে দেখার নয়। দিঘলিয়া থানা অফিসার ইনচার্জ রিপন কুমার সরকার এ প্রতিবেদককে বলেন, এটা শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একার কাজ নয়, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। খুলনা পুলিশ বলেন, রাজনীতির দুষ্টচক্রে নিজের স্বার্থে কেউ কিশোর গ্যাং গড়ে তুললে পুলিশের ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখবো।