জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই বিরল রোগে আক্রান্ত তিন ভাইবোন। দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে তাদের হাত-পা। সন্তানদের চিকিৎসার জন্য জমি বিক্রি করেও সঠিক চিকিৎসা করাতে পারেননি বাবা-মা। একদিকে সংসারের খরচ, অন্যদিকে সন্তানদের চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। এখন সমাজের বিত্তবান ও সরকারের সহায়তা চায় এই পরিবার। উপজেলার আজমপুর গ্রামের ভ্যানচালক হানিফ মিয়া ও আছমা খাতুন দম্পতির তিন সন্তান বিরল রোগে আক্রান্ত হয়েছে। বড় সন্তান মো সবুজ হোসেনের বয়স ১৮ বছর, দ্বিতীয় সন্তান জিহাদের বয়স ১২ বছর, ছোট সস্তান আবিদার বয়স ৩ বছর। জন্মের ৭-৮ মাস পর থেকেই তাদের হাত-পা শুকিয়ে যাচ্ছে। তবে কি কারণে এমনটা হচ্ছে, এই রোগের চিকিৎসাই বা কী তাও বলতে পারছেন চিকিৎসকরা। সরেজমিনে ভ্যানচালক হানিফ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বড় ছেলে মো. সবুজ হোসেন সম্পূর্ণ পঙ্গু অবস্থায় বাড়ির পাশে লাগোয়া ছোট একটি চায়ের দোকানে বসে দোকানদারি করছেন। ছোট ভাই জিহাদ দোকানের সামনে চৌকিতে বসে ছোট বোনের সঙ্গে খেলছে। তবে কেউ নিজে নিজে একস্থান থেকে অন্য স্থানে চলাফেরা করতে পারছে না। ১৮ বছরের সবুজকে তার বাবা অথবা দাদা কোলে করে দোকানে রেখে যান, আবার প্রয়োজনহলে তাদের কোলে চড়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সারেন। এভাবেই মা, বাবা, দাদা আর দাদির ওপর নির্ভর করে চলতে হয় তিন ভাইবোনকে। হানিফ মিয়া জানান, বড় ছেলে জন্মের ৭-৮ মাসের মধ্যেই তার হাত-পা শুকিয়ে যায়। তখন জেলার সদর হাসপাতালসহ পাশের জেলাতেও তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার কোনো রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। এরপর দ্বিতীয় সন্তানের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা দেখা দেয়। এরপর মেয়ে হয়, মেয়েটাও একই সমস্যাই ভুগছে। তাকে ডাক্তার দেখানো হয়েছে ডাক্তার বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ওষুধ দিয়েছে, কিন্তু কী কারণে এই রোগ তা ডাক্তার নির্ণয় করতে পারেননি।তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিন সন্তানের চিকিৎসার খরচ মেটানো আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যদি সঠিক ভাবে রোগটা নির্ণয় করা যেত তাহলে জীবনের শেষ সম্বল দিয়ে হলেও তাদের চিকিৎসা করাতে পারতাম। বর্তমানে পরিবারের এমন একটি পরিবেশ একদিকে সন্তানদের চিকিৎসা খরচ অন্যদিকে মুখের আহার এবং সংসারের বোঝা, কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এখন একমাত্র ভরসা সমাজের বিত্তবান, দানশীল মানুষ এবং সরকারি সহয়তা। হানিফের স্ত্রী আছমা খাতুন বলেন, আমি বিরল রোগে আক্রান্ত তিন সন্তানের হতভাগা মা। দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে সন্তানদের চিকিৎসা করাতে করাতে সংসারে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে যে তাদের মুখে খাবার দেব, না চিকিৎসা করাব। অনেক ডাক্তারের কাছে গেছি, ডাক্তার রোগ নির্ণয়ের জন্য যে পরীক্ষা দিয়েছে সেই পরীক্ষাই করা হয়েছে, কিন্তু কোনো রোগ নির্ণয় হয়নি। তারপরও আমরা হাল ছাড়িনি। তিনি বলেন, জন্মের ৭-৮ মাস পর থেকেই বাচ্চাদের হাত-পা শুকিয়ে যায়। আস্তে আস্তে তাদের হাত-পায়ের মাংস শুকিয়ে হাতে-পায়ে বল পায় না। হাতে ভারি কিছু তুলতে পারে না। তবে স্বাভাবিক ভাবে তারা খাওয়া-দাওয়া করে। প্রথমে বড় ছেলেকে ঝিনাইদহ সদর হাসপাতাল, যশোর ও কুষ্টিয়ায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছে। দ্বিতীয় সন্তানকেও বিভিন্ন জায়গাই নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়েছি। ছোট মেয়েটাকে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়েছে। ডাক্তার কয়েকটি পরীক্ষা করিয়েছেন, কিন্তু এখনো রোগ নির্ণয় করতে পারেননি। তবে চেষ্টা করা হচ্ছে। মেয়েটা যদি চিকিৎসার মাধ্যমে একটু ভালো হতো তাহলেও উপকৃত হতাম। বর্তমানে সংসারে লোকজন বেড়ে গেছে অনেক, কিন্তু উপার্জনের লোক একজন, এজন্য পরিবারের খরচ চালিয়ে বাচ্চাদের উন্নত চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য নেই। তবে যদি কেউ সহযোগিতা করে, অথবা সরকারি ভাবে তাদের চিকিৎসা করা হয়, তাহলে ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারতাম। বড় ছেলে সবুজ হোসেন জানান, আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারেননি বাবা-মা। ছোট থেকেই বাবা, মা, দাদা ও দাদির কোলে চড়ে নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করতে হয়। দুই বছর আগে গ্রাম থেকে এবং নিজে কিছু টাকা জোগাড় করে ছোট্ট চায়ের দোকান দিয়েছেন। সেখানে দোকানদারি করতে বাবা অথবা দাদার ওপর নির্ভর করতে হয়। জন্মের কয়েক মাস পর থেকেই তিনি এই বিরল রোগে আক্রান্ত। দ্বিতীয় ছেলে জিহাদ বলে, বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই দেখছি হাত-পা শুকিয়ে যাচ্ছে। বন্ধুরা সামনে দিয়ে যখন স্কুলে যায় তথন তার খুবই খারাপ লাগে। মায়ের কাছে বাড়িতে বসেই পড়তে হয়। মা-বাবা গরিব হওয়ায় ভালোভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি। শুধু খাবার খাওয়া ছাড়া অন্য কিছুই করতে পারি না। সবুজের দাদা মোরশেদ আলী বলেন, আমার ছেলের পরিবারে পরপর তিন সন্তান হয়েছে। তিনটি সন্তানই প্রতিবন্ধী। কিন্তু কি কারণে এই রোগ আক্রান্ত হয়েছে তা আজও জানতে পারিনি। তারা কেউই অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারে না। আমরা গরিব ও অসহায় মানুষ, নিজেদের তেমন সামর্থ্য নেই যে ওদের উন্নত চিকিংসা করাব। যদি কেউ ওদের দিকে তাকিয়ে সহযোগিতা করে তাহলে হয়তো ওদের ভাগ্যের পরিবর্তন হতে পারে। প্রতিবেশি মাসুম বিল্লাহ জানান, একই পরিবারে পর পর তিনজন ছেলে-মেয়ে সবাই প্রতিবন্ধী। ওদের দেখতে অনেক খারাপ লাগে। ওদের কেউ নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারে না। দাদা, দাদি, বাবা ও মায়ের ওপর নির্ভর করে চলতে হয়। ওদের জীবনযাপন অনেক কষ্টের। পরিবার গরিব ও অসহায় হওয়ায় ভালো করে চিকিৎসাও করাতে পারে না। আরেক প্রতিবেশি আবু জাফর জানান, হানিফ মিয়ার পরিবার খুবই অসহায়। বড় ছেলে হওয়ার ৭-৮ মাস পরেই এই সমস্যা। হাত-পা শুকিয়ে আসতে থাকে। পরে ঝিনাইদহ, যশোর ও কুষ্টিয়ায় নিয়ে যায় ডাক্তার দেখাতে। কিন্তু কোনো ওষুধে কাজ হয় না। এরপর আস্তে আস্ত্ েবড় হতে থাকে, তখন হাত পা শুকিয়ে পঙঙ্গু হতে থাকে। বর্তমানে তার তিনটি সন্তান একই রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবন্ধি। হানিফের সামর্থ্য নেই যে ছেলেমেয়েদের চিকিৎসা করাবেন। গ্রামের মানুষের সহযোগিতায় এই ছোট্ট দোকান করে দেওয়া হয়েছে, বড় ছেলেটি সারাদিন দোকানেই বসে থাকে। ১২ নং মহেশপুর আজমপুর ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, আজমপুর গ্রামের হানিফ মিয়ার পরিবারে তিনটি সন্তান, তিনটি সন্তানই প্রতিবন্ধি। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে তাদের বড় ছেলেকে প্রতিবন্ধি ভাতা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় সন্তানকেও প্রতিবন্ধি ভাতা করে দেওয়া হয়েছে। ছোট বাচ্চাটার বয়স না হওয়ায় তাকে প্রতিবন্ধি ভাতার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। তবে মেয়েটার ৭ বছর পূর্ণ হলে তাকেও প্রতিবন্ধি ভাতার আওতায় আনা সম্ভব হবে। তিনি বলেন, পরিবারটি অসহায় হওয়ায় তিন সন্তানকে সঠিক ভাবে চিকিৎসা করাতে পারেনি। তেমন সামর্থ্যও নেই হানিফের। বাচ্চাগুলো নিজেদের কাজ নিজেরাও করতে পারে না। তাদের উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারি সহায়তার পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসতে হবে। ঢাকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স ও হাসপাতালের নবজাতক ও শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শেখ মশিউর রহমান বলেন, আমাদের তত্ব্বাধানে নিউরোসায়েন্সের একটি টিম ওই পরিবারের ছোট বাচ্চা আবিদাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছে। বাচ্চাটির রক্ত পরীক্ষাসহ সব ধরনের পরীক্ষা শেষ করা হয়েছে। ওর শরীরে স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি(এফএমএ) রোগ ধরা পড়েছে। এই রোগটি একটি বিরল ও জটিল স্নায়ুতন্ত্রের জন্মগত রোগ, যা জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। আগে এই রোগের কোনো চিকিৎসা ছিল না, এ রোগে আক্রান্ত শিশুরা বসতে বা দাড়াতে পারে না, হাত পা শুকিয়ে যায়। তবে তাদের বুদ্ধিমত্তা ঠিক থাকে। ওদের বয়সে এই রোগের স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। তবে তার বয়স দুই বছরের কম হলে লটারির মাধ্যমে আমেরিকা থেকে ২২ কোটি টাকা মূল্যের ইনজেকশন দিলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ওদের দুই বছরের বেশি বয়ম যার কারণে ২২ কোটি টাকা মূল্যের ইনজেকশন পাওয়া সম্ভব নয়। তবে মুখে খাওয়ার জন্য কিছু ওষুধ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সেগুলো খেলেই যে ভালো হয়ে যাবে এমন নয়। স্থানীভাবে আমাদের দেশে এই রোগের কোনো চিকিৎসা নেই। বাচ্চাটির পরিবারকে নিউরোসায়েন্স টিমের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। ভবিষ্যতে যদি এই রোগের কোণো প্রতিশেথক পাওয়া যায়। তাহলে তাদের চিকিৎসা দেওযা যেতে পারে।